মুসলিম বিশ্বের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে গত বুধবার মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলমানদের প্রথম কিবলা এবং পবিত্র স্থান জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ট্রাম্প স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন, এখন সময় এসেছে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার। তার এ ঘোষণায় সারা বিশ্বের মুসলমানদের হৃদয়ে অপরিমেয় আঘাত লাগে এবং সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ক্ষোভ এবং বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতির প্রতিবাদে ইন্তিফাদা বা গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছে ফিলিস্তিন প্রতিরোধ সংস্থা হামাস। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্র ব্রিটেন, ফ্রান্স, সউদী আরবও এ স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করেছে। ট্রাম্পের একতরফা সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেছেন, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত শান্তি উদ্যোগের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখবে না। সউদী সরকার বলেছে, ট্রাম্পের এ ঘোষণা ‘অযৌক্তিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’। যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপে শান্তি প্রক্রিয়ার প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তার দেশ জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেবে না। এর মর্যাদা কেবল দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হতে পারে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, তার দেশের দূতাবাস তেল আবিবেই থাকবে। চীন, রাশিয়াও ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদেশনীতিবিষয়ক প্রধান ফেডেরিক মোঘেরিনি বলেছেন, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত এ অঞ্চলকে অন্ধকার যুগের দিকে ধাবিত করবে। তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’। এ সিদ্ধান্তে পুরো অঞ্চলে ‘আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত’ হবে। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে ইসরাইলের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ শুরু করার চেষ্টা করছে। বলা বাহুল্য, বিশ্ব নেতারা ট্রাম্পের এ ঘোষণাকে সর্বাত্মকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এদিকে বিশ্বের তৃতীয় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে বাংলাদেশও ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তকে ‘গ্রহণযোগ্য’ নয় বলে অভিহিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ট্রাম্পের এ ঘোষণা গ্রহণযোগ্য নয় এবং জাতিসংঘের রেজুলেশনকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। অন্যতম শীর্ষ মুসলিম দেশের সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার দ্রæত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা ধন্যবাদযোগ্য এবং বাংলাদেশের এ প্রতিক্রিয়া বিশ্বে মর্যাদা পাবে।
বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে হঠাৎ করে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে তার দেশের জনগণের মধ্যেও দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টি করেছে। সেখানে বসবাসরত ক্ষুদ্র ইহুদী জনগোষ্ঠী ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাকী জনগণ তা গ্রহণ করেনি। ট্রাম্পের এ ঘোষণার মাধ্যমে তার যে মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব, তা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে ও পরে ট্রাম্পের অবিমৃষ্যকারী মন্তব্য, বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত সারা বিশ্বে বিতর্ক সৃষ্টির পাশাপাশি একের পর এক সংকটও সৃষ্টি করছে। জেরুজালেম নিয়ে দশকের পর দশক ধরে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিরোধ চলছে। এ নিয়ে ব্যাপক সংঘাত-সংঘর্ষ ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে। ফলে কোনো পক্ষকেই স্বীকৃতি না দেয়ার মার্কিন নীতি বহু বছর ধরেই চলে আসছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি এ নীতির বরখেলাপ এবং বিশ্বজনমতের তোয়াক্কা না করে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিলেন। এ যাবৎ বিশ্বের কোনো দেশই জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং শান্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের তাকিদ দিয়েছে। ট্রাম্পের এক ঘোষণায় তা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমনকি ট্রাম্পের এ ঘোষণা নিয়ে খোদ মার্কিন প্রশাসনেই বিভক্তি রয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন, প্রতিরক্ষমন্ত্রী জেমস ম্যাটিস, সিআইয়ের পরিচালক মাইক পম্পে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী করার বিপক্ষে ছিলেন। তারা চাচ্ছিলেন, বিদ্যমান অবস্থা বজায় থাকুক। বহু দশক ধরে চলে আসা মার্কিন নীতি অব্যাহত থাকুক। ব্যক্তিগতভাবে তারা ট্রাম্পকে অনুরোধও করেছিলেন। ট্রাম্প তা না শুনে ঘোষণা দিয়ে দেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের যে প্রস্তাবের ভিত্তিতে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভেঙ্গে একেিক ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল, অন্যদিকে আরব ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হয় এবং জেরুজালেমের জন্য স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হয়। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর ইসরাইল পূর্ব ও পশ্চিম জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং এককভাবে তা নিজ দেশে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনো মেনে নেয়নি। ১৯৯৫ সালে ইসরাইল ও পিএলও স্বাক্ষরিত অসলো শান্তিচুক্তিতে উভয় পক্ষ মেনে নেয় যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জেরুজালেমের বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ২০০০ সালে হোয়াইট হাউসের লনে ইসরাইলি নেতা রবিন ও ফিলিস্তিনি নেতা আরাফাত যে শান্তি কাঠামো স্বাক্ষর করেন, তাতেও জেরুজালেম বিষয়ে উভয় পক্ষের সম্মতি ছিল। ঐতিহাসিক এসব চুক্তি ও সিদ্ধান্ত এক নিমিষে উড়িয়ে দিয়ে ট্রাম্প একতরফাভাবে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দেন। এতে দশকের পর দশক ধরে চলে আসা শান্তি প্রক্রিয়াটি যেমন কর্পূরের মতো উবে গেল, তেমনি সারা বিশ্বে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও রক্তপাতের সূচনা হয়েছে। হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, ইহুদীবাদী শত্রæর বিরুদ্ধে আমাদের ইন্তিফাদার ডাক দেয়া হয়েছে। জেরুজালেম ও পশ্চিম তীর মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এটি চলবে। শুরু হওয়া সংঘাতের প্রথম দিন অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে এবং অনেকে মৃত্যুমুখে রয়েছে। বেথলহেম শহরেও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে ট্রাম্পের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়েছে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজন বড়দিন উপলক্ষে সাজানো ক্রিসমাস ট্রির আলোকসজ্জা বন্ধ করে দিয়েছে। ট্রাম্পের এ ঘোষণা মূলত ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যকে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাস উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এটি খুবই উৎকণ্ঠার বিষয়। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান ছাড়া এর আর কোনো বিকল্প নেই। এ পরিস্থিতিতে ১৩ ডিসেম্বর ওআইসির বিশেষ শীর্ষ সম্মেলন ডেকেছে তুরস্ক। বলিভিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, স্ইুডেন, মিসর, ও উরুগুয়ের অনুরোধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। বাংলাদেশ সময় গতকাল রাত ৯ টায় এ বৈঠক শুরু হওয়ার কথা। আজ বৈঠকে বসবে আরব লীগ।
মুসলিম বিশ্বের মধ্যে যে ভেদাভেদ রয়েছে, তা নিরসন করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া এখন আর বিকল্প নেই। কারণ ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়ে প্রকারন্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তার মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাবের বাস্তবায়নে মুসলমানদের পবিত্র স্থান জেরুজালেমকে বেছে নিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে মুসলমানদের মধ্যে যে মতবিরোধ রয়েছে, তা এখন ভুলে যেতে হবে। শিয়া, সুন্নীসহ অন্যান্য যেসব মতাবলম্বী রয়েছে, তাদের এক অবস্থানে আসতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি ওআইসি, আরব লীগ, জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী দেশগুলোকে নিয়ে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। জেরুজালেম নিয়ে যে সংঘাত শুরু হয়েছে এবং তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার যে আশঙ্কা রয়েছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন