শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের খেসারত : পরিবেশ সুরক্ষার বিকল্প নেই

| প্রকাশের সময় : ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সমীক্ষা-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন। পরিবেশের সবচেয়ে ক্ষতি ও বিপর্যয় ঘটেছে ঢাকাসহ শহরগুলোতে সেখানকার মানুষ বিশেষ করে শিশুরা অপরিমেয় ক্ষতির শিকার। বায়ু, পানি ইত্যাদিতে দূষণের মাত্রা অত্যাধিক। একারণে বছরে আর্থিক যে ক্ষতি সাধিত হচ্ছে তার পরিমাণ প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ দশমিক শতাংশ। রাজধানী ঢাকা সর্বাধিক দূষণের গ্রাসে পতিত। ঢাকার দূষণের যে চিত্র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তা এক কথায় ভয়াবহ। ইতোপূর্বে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষায় ঢাকার পরিবেশ সংক্রান্ত যে সব তথ্য পাওয়া গেছে, এ প্রতিবেদন বর্ণিত তথ্যের সঙ্গে তার খুব একটা ফারাক নেই। বলা যায়, ঢাকার পরিবেশ সম্পর্কিত একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখানে পাওয়া গেছে। ওয়াকিবহাল মহলের অবিদিত নেই, দক্ষিণ-এশিয়ার প্রধান ও উল্লেখযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষণ কবলিত শহর দিল্লী। বায়ু দূষণ সেখানে এতটাই প্রকট যে, মানুষ এর জেরে বিভিন্ন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য সেখানে বিশুদ্ধ বায়ুর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। কিছুদিন আগে এই বায়ুদূষণ নিয়ে ভারতে হৈচৈ হয়ে গেছে। অনেকে মনে করেন, এক্ষেত্রে ঢাকা দিল্লীর থেকে খুব পিছিয়ে নেই। এখানকার বায়ুতে সিসাসহ স্বাস্থ্যহানিকর বিভিন্ন উপাদান অধিক মাত্রায় বিদ্যমান। শহরে এমন ৫৯টি এলাকা রয়েছে যা তীব্রমাত্রায় সিসায় আক্রান্ত। এসব এলাকার মাটি ও পানিতে রয়েছে আর্সেনিক, ক্যাডসিয়াম, ক্রোমিয়াম, ক্ষুদ্র বস্তুকনা ও সালফার ডাইঅক্সাইড। পানি দূষণের ব্যাপারটিও মারাত্মক। ঢাকায় যে প্রাকৃতিক খালগুলো ছিল তা দখল-দূষণে শেষ হয়ে গেছে। এর চারপাশের নদীগুলোও মানব ও কারখানায় বর্জে ভরাট এবং যারপরনেই দূষিত হয়ে পড়েছে। সাধারণত, মৎস্য ও জলজপ্রাণীর জীবন ধারণের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে ন্যূনতম ৫ মিলিগ্রাম থাকা প্রয়োজন। অথচ ঢাকার মিরপুর, হাজারিবাগ, চাঁদনিঘাট, সদরঘাট প্রভৃতি এলাকার খালে ও নদীতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
ঢাকায় বায়ু ও পানি দূষণের মতো শব্দ দূষণ, বর্জ্য দূষণও আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশী। যানবাহন ও কলকারখানার শব্দে প্রতিনিয়ত শহরবাসীর কানের ওপর সে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে তাতে কান বধির হয়ে যাওয়া ছাড়াও হৃদরোগসহ নানবিধ রোগের প্রকোপ বাড়ছে। আর আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে যা বুঝায়, তার কোনো অস্তিত্ব ঢাকা শহরে নেই। যত্রতত্র বর্জ্য ফেলানো হয়। এ ব্যাপারে নাগরিক সচেতনতা লেশমাত্র লক্ষ্য করা যায় না। আবার ফেলে দেয়া বর্জ্য দিনের পর দিন রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ময়লা-অবর্জনা পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। দ্রুত বর্জ্য অপসারণ এবং নির্দিষ্ট ও নিরাপদ স্থানে তা সরিয়ে নেয়ার পুন:পুন তাকিদও কোনো ফল দেয় না। শুধুমাত্র পরিবেশ দূষণের কারণেই ঢাকা বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে। এছাড়া, যানজট, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, আবাসিক এলাকায় কলকারখানা, বস্তি প্রভৃতি কারণে এই শহরের অবস্থা দিনে দিনে এতটাই নাজুক হয়ে পড়ছে যে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এমন একটা সময় আসবে যখন এই শহরের অধিবাসীরা বসবাস উঠিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে। রাজধানী শহরের এমন বেহাল অকল্পনীয় ও দুর্ভাগ্যজনক। ঢাকার মত অন্যান্য বড় শহরের অবস্থাও দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে। দূষণের যাবতীয় উপকরণ ওইসব শহরেও অতিমাত্রায় সক্রিয়। পরিবেশের দিক দিয়ে গোটা দেশই যে ঝুঁকিতে আছে, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে সহজেই তা অনুধাবন করা যায়।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নই যেহেতু পরিবেশ বিনাশের প্রধান কারণ, সুতরাং এই দুটি ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যাতে পরিকল্পনাহীনভাবে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন হতে না পারে। নগর সম্প্রসারণ ও শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা যেমন থাকতে হবে তেমনি এ ব্যাপারে কাম্য পরিবেশের শর্তসমূহ যাতে লঙ্ঘিত না হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম হতে হবে পরিবেশসম্মত। তা না হলে টেকসই উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হবে না। পরিবেশ ধ্বংস করে কখনোই টেকসই উন্নয়নও প্রবৃদ্ধি আশা করা যায় না। দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে তা তখনই সফল ও সার্থক হবে যখন পরিবেশ সুরক্ষা করে তা এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। পরিবেশকে অমান্য করে, উপেক্ষা করে, গুরুত্ব না দিয়ে যা কিছুই করা হোক না কেন, তার ফল শুভ হতে পারে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন