আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় রাজধানীতে যাতায়াত ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে। গণপরিবহন সংকট ও সিএনজি অটোরিক্সার স্বেচ্ছাচারিতা এড়িয়ে অ্যাপস নির্ভর প্রাইভেট কারের মাধ্যমে কর্মজীবীসহ সাধারণ মানুষের ভোগান্তি যেমন কমছে, তেমনি আরামদায়ক, নিরাপদ ভ্রমনের পাশাপাশি সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। প্রায় দেড় বছর আগে মোবাইল অ্যাপস-এর মাধ্যমে উবার নামে প্রযুক্তি নির্ভর পরিবহন সার্ভিসটি যাত্রা শুরু করে। মোবাইল অ্যাপস-এর মাধ্যমে যে কোনো যাত্রী প্রতিষ্ঠানকে যাওয়ার আহ্বান জানালে সঙ্গে সঙ্গে তারা সাড়া দিয়ে থাকে। যাত্রীকে কোথা থেকে, কখন তুলে নিতে হবে তা জানার কিছুক্ষণের মধ্যে এসে হাজির হয়। তার আগে ভাড়া কত পরবে, যাত্রীর কাছে পৌঁছতে কতক্ষণ সময় লাগবে অ্যাপসের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়। যাত্রী রাজী হলে দ্রুত সেখানে এসে উপস্থিত হয়। যাত্রীর মোবাইলেও ভাড়া এবং ওয়েটিং চার্জ কত উঠছে তা ভেসে উঠে। বাসায় বসে উবার কল করলে বাসার কাছে এসে হাজির হয়। যাত্রীকে রাস্তায় বের হয়ে গাড়ি খোঁজাখুঁজির প্রয়োজন পড়ে না। ভাড়াও সিএনজি অটোরিক্সার তুলনায় সাশ্রয়ী। রাস্তায় বের হয়ে সিএনজি অটোরিক্সা পেতে যাত্রীদের যে পেরেশানিতে পড়তে হয় এবং পেলেও চালকদের স্বেচ্ছাচারি মনোভাব, সরকার নির্ধারিত ভাড়া না মানা, মিটারে না চলা ইত্যকার যে ভোগান্তি সহ্য করতে হয়, উবার এবং অন্যান্য অ্যাপসভিত্তিক সার্ভিসের ক্ষেত্রে এর কোনো কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না। যাত্রীরা নিশ্চিন্তে মানসিক প্রশান্তিতে এর মাধ্যমে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারে। ফলে উবার ক্রমেই জনপ্রিয় বাহনে পরিণত হয়েছে। শুধু উবার নয়, যানজট এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে পাঠাও নামে মটর সাইকেল সার্ভিসও চালু হয়েছে। এ সার্ভিসের মাধ্যমে সাশ্রয়ী এবং স্বল্প সময়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যায়। যাদের প্রাইভেট কার যানজটে আটকে থাকে, তাদের অনেকেই দ্রুত গন্তব্যস্থলে বসে অ্যাপসের মাধ্যমে পাঠাও সার্ভিস কল করে গাড়ি থেকে নেমে মটর সাইকেলে চলে যায়। উবার, পাঠাও-এর মতো ট্যাক্সিওয়ালা, আমারবাইক সার্ভিসও চালু হয়েছে। অ্যাপসভিত্তিক এসব পরিবহন সার্ভিস নগরবাসীর মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং তাদের ভোগান্তিও অনেকটা কমেছে।
পার্শ্ববর্তী ভারত, চীনসহ উন্নত দেশগুলোতে অ্যাপস ভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থা অনেক আগেই চালু হয়েছে। যাত্রীদের নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে আস্থা অর্জন করেছে। আমাদের দেশে এ সার্ভিস নতুন হলেও এর চাহিদা ও জনপ্রিয়তা অভাবনীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিএনজি অটোরিক্সার দৌরাত্মে যাত্রীদের যখন নাভিশ্বাস এবং কিছুতেই এর প্রতিকার পাচ্ছিল না, তখন এ ধরনের ঝামেলাবিহীন নিরাপদ পরিবহন যাত্রীদের মধ্যে স্বস্তি বয়ে এনেছে। কর্মজীবীদের মধ্যে যারা সাধারণত সিএনজি অটোরিকসায় চলাফেরা করেন, তাদের বেশিরভাগই এখন উবারে চলাফেরা করেন। বিশেষ করে অফিস টাইম ও অফিস ছুটির পর তাদের এখন আর তীর্থের কাকের মতো সিএনজি অটোরিকসা বা বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এ সার্ভিস পুরোপুরিভাবে নিরাপদ ও আরামদায়ক। অ্যাপসে গাড়ির বিস্তারিত বিবরণসহ গাড়ি চালকের পুরো বায়োডাটা থাকে। ফলে কোনো ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা ঘটার আশঙ্কা খুবই কম। অ্যাপস ভিত্তিক যানবাহন জনপ্রিয় হয়ে উঠায় দিন দিন এর গাড়ির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে রাজধানীতে প্রায় ১০ হাজার উবার গাড়ি রয়েছে। প্রতিদিন এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরও ১০০ গাড়ি। বাড়তি আয়ের জন্য যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে তাদের অনেকে এ সার্ভিসে গাড়ি যুক্ত করছেন। অনেকে গাড়ি কিনে এ সার্ভিসে দিয়ে দিচ্ছে। এতে আর্থিকভাবেও তারা লাভবান হচ্ছে। মাসে প্রত্যেকের গড়ে ২০ হাজার টাকার মতো আয় হয়। গত মাসে উবার প্রায় ১৫ লাখ যাত্রীর আহ্বান পায়। এর মধ্যে দুই লাখ যাত্রী পরিবহন করা হয়। পাঠাও-এর সাথে নিজস্ব মটর সাইকেল নিয়ে অনেকে যুক্ত হয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। এর মাধ্যমে অনেকে মাসে গড়ে ৩০ হাজার টাকা রোজগার করছে। বর্তমানে প্রায় এক হাজার মটর সাইকেল এই অ্যাপসের সাথে যুক্ত রয়েছে। অ্যাপসভিত্তিক এই পরিবহন ব্যবস্থা একদিকে যাত্রীদের দুর্ভোগ কমিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে ব্যাপক কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করেছে। তবে সিএনজি অটোরিকসা মালিক সমিতি এর বিরোধিতা করা শুরু করেছে। কারণ এসব আধুনিক প্রযুক্তির পরিবহন ব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে উঠায় তাদের চাহিদা ও আয় কমে গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যাত্রীদের সাথে তাদের স্বেচ্ছাচারি মনোভাব, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, অনুরোধ সত্তে¡ও না যাওয়া এবং দুর্ব্যবহারই এর জন্য দায়ী। তাদের মনে রাখা উচিত, কোনো কিছুই কারো জন্য ঠেকে থাকে না। এক পথ কঠিন হয়ে উঠলে, বিকল্প পথ সৃষ্টি হয়। অ্যাপসভিত্তিক পরিবহন সার্ভিস তারই প্রতিক্রিয়া। অবশ্য আধুনিক যুগে এ ধরনের সার্ভিসের আবির্ভাব অনিবার্য। একে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সারা বিশ্ব যখন পরিবহন খাতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, তখন আমাদেরও পিছিয়ে থাকার কারণ নেই। তবে যেসব সিএনজি অটোরিকসা রয়েছে, তাদের উচিত হবে অ্যাপসভিত্তিক পরিবহন সার্ভিসের সাথে সমন্বয় করে এগিয়ে যাওয়া। পরিবহন খাতে নিত্য-নতুন যাত্রী সার্ভিস যুক্ত হবে এবং প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে এ বাস্তবতা মেনে নেয়া।
অ্যাপসভিত্তিক যেসব সার্ভিস চালু রয়েছে সেগুলোকে উৎসাহিত করা যেমন জরুরী, তেমনি এসব সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার মধ্যে রাখাও অপরিহার্য। এজন্য যাত্রী উপযোগী একটি সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। ইতোমধ্যে উবার এবং পাঠাও বিআরটিএ-এর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে বলে জানা গেছে। বিআরটিএ অ্যাপসভিত্তিক এসব পরিবহন সার্ভিসকে উৎসাহিত করে নিয়ম-নীতির খসড়া তৈরি করেছে। এর ফলে প্রযুক্তি নির্ভর এ ধরনের সার্ভিস সুশৃঙ্খলার মধ্যে চলবে এবং এতে রাজধানীর তীব্র পরিবহন সংকটও অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। এমনকি যে প্রাইভেট কার সড়কের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে থাকে এবং সবচেয়ে কম মানুষ পরিবহন করে, তার সংখ্যাও কমে আসবে। ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়িও অ্যাপসের সাথে যুক্ত হয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করে তুলবে এবং তাদের আয়ও বৃদ্ধি পাবে। আমরা এ ধরনের অ্যাপসভিত্তিক পরিবহনকে স্বাগত জানাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন