শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে হরিলুট চলছেই

প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড়ের মধ্যেই এবার রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে চুরি করা টাকার বস্তাসহ আটক হলেন ব্যাংকের এক কর্মকর্তা। জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে ২ কোটি টাকা লোপাট হওয়ার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সিনিয়র অফিসার রাজিব হাসানকে সন্দেহভাজন হিসেবে কয়েকদিন নজরদারিতে রাখার পর অবশেষে সোমবার ধানমন্ডিতে তার বাসায় হানা দিয়ে ৭৮ লাখ টাকার বস্তাসহ তাকে ধরে আনতে সক্ষম হয়। অবশিষ্ট ১ কোটি ২২ লাখ টাকার হদিস এখনো মিলেনি বলে জানা যায়। বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের টাকা লোপাটের ধারাবাহিক ঘটনা পুরো ব্যাংকিং সেক্টর এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে দুর্নীতি ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে গত ৫ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার ঘটনায় এই সেক্টরের নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে বড় ধরনের আশঙ্কা তৈরী হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ৪ বছরে সরকারী-বেসরকারী ৮টি ব্যাংকের ১৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সুনির্দিষ্ট অভিযুক্ত ১৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের সাড়ে ১৩ হাজার কোটিই সংঘটিত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী, কৃষি ও বেসিক ব্যাংক থেকে। যদিও ব্যাংকিং খাতের জাল-জালিয়াতি ও লুটপাটের প্রকৃত অবস্থা আরো ভয়াবহ। বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক জরিপ রিপোর্টে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দেশী-বিদেশী ব্যাংকিং চ্যানেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এমন ধারাবাহিক লুণ্ঠন সম্ভব নয়।
ব্যাংকের টাকা লুণ্ঠনের এমন মচ্ছব বিশ্বের আর কোথাও কখনো ঘটেছে কিনা আমাদের জানা নেই। সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকিং সেক্টরের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, লুটপাটের ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও দায় রয়েছে। ব্যাংক পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি, নির্দেশনা বাস্তবায়ন, তদারকি, তদন্ত ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার কারণেই ব্যাংকিং চ্যানেল দিয়ে লক্ষ কোটি টাকা পাচার করার সুযোগ পেয়েছে দেশের রাঘব বোয়ালরা। এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা রিজার্ভ চুরি এবং আরো ৭ হাজার কোটি টাকা চুরির মাঝপথে আটকে থাকার ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি বড় ধরনের কেলেঙ্কারির সম্মুখীন হলো। হ্যাকারদের মাধ্যমে শত মিলিয়ন ডলার বেহাত হওয়ার পর দীর্ঘদিনের নীরবতা শেষে বিদেশী গণমাধ্যমে ঘটনা ফাঁস হওয়ার পরও ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার নানাবিধ কসরত দেখে টাকা ফেরত পাওয়ার প্রত্যাশা এখন অনেকটাই দুরাশায় পরিণত হয়েছে। চোর-ডাকাত ধরা পড়ার পর চুরি-ডাকাতির মালামাল ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও রাষ্ট্রীয় ব্যাংক এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের হোতারা অধরা থাকবে এবং জনগণের লুণ্ঠিত সম্পদ জনগণ ফেরত পাবেনা, কোন বিচার হবেনা, এমন ধারণাই এখন জনগণের মধ্যে বদ্ধমূল হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনায় কয়েকজন ডেপুটি গভর্নরসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত ১০জন কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হয়েছে। নৈতিক দায় নিয়ে স্বেচ্ছায় অথবা ভিন্ন কোন চাপে ইতিমধ্যে গভর্নর ড.আতিউর রহমানও পদত্যাগ করেছেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইটি সেক্টরের প্রধান উপদেষ্টা রাকেশ আস্তানা এবং তার প্রতিষ্ঠানকে দেশীয় বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা সন্দেহের তালিকায় রাখলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ শুরু থেকে তার সম্পর্কে রহস্যজনক আচরণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অনলাইনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকার চুরির দায় আইটি পরামর্শক ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানা কোনভাবেই এড়াতে পারেন না। অথচ এই কেলেঙ্কারির তদন্তেও রাকেশ আস্তানাকে খুবই সক্রিয় দেখা গেছে এবং এ কাজে তার ভূমিকাও ইতিমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। রাকেশ আস্তানা টাকা চুরির ঘটনার জন্য আন্তর্জাতিক হ্যাকারদের দায়ী করলেও ভেতরের কুশীলবদের ভূমিকা এখন নানাভাবে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। গতকাল একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরিতে সুইফ্ট কোডের সাথে আরটিজিএস (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) সংযোগের একটি যোগসূত্র থাকার কথা বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুইফ্ট কোড অত্যন্ত গোপনীয় এবং বিশেষভাবে সংরক্ষণের বিষয়। কিন্তু বিশেষ কোন নিরাপত্তাব্যবস্থা, ফায়ারওয়াল নিশ্চিত না করেই লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক এবং আরটিজিএস সংযোগের মাধ্যমে সাধারণ কম্পিউটারে সংযুক্ত করার পরামর্শ কে দিয়েছিল। এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনার তদন্ত, বিচার এবং বেহাত হয়ে যাওয়া টাকা ফেরত আনার কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন বন্ধ করা অসম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ প্রতিটি সরকারী-বেসরকারী ব্যাংক থেকে টাকা লুণ্ঠনের সাথে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন