কিছুটা স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিককালে অপহৃত সাংবাদিক, শিক্ষক, পেশাজীবীসহ বেশ কয়েকজন ফিরে এসেছে। তবে তারা স্বেচ্ছায় ফিরে আসেনি, অপহরণকারীরা তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। যেভাবেই হোক, শোকে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত পরিবারের কাছে এসব অপহৃতরা ফিরে এসেছে। কারা কেন তাদের অপহরণ করেছে আবার ফিরিয়ে দিয়েছে, তার কোনো সুস্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি। ফিরে আসা অপহৃতদের কেউ কেউ বলেছে, অর্থ আদায়ের জন্য অপহরণকারীরা অপহরণ করেছে। আবার অপহৃতদের কাছ থেকে অর্থ না পেয়ে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ সপ্তাহে অপহৃত সাংবাদিক উৎপল দাস এবং শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান ফিরে এসে বলেছে, অপহরণকারীরা অর্থের জন্য তাদের অপহরণ করেছিল। এর বেশি কিছু তারা বলতে পারেনি। তাদের কথাবার্তা ও শারিরীক ভাষায় ছিল প্রচন্ড ভীতি। গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত যে ১২ জন অপহৃত হয়েছে, তাদের মধ্যে ৫ জনকে অপহরণকারীরা ফিরিয়ে দিয়েছে। ৩ জনকে পুলিশ গ্রেফতার দেখিয়েছে। বাকীদের এখন পর্যন্ত কোনো হদিস নেই। তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা বা অপহরণকারীরা ফিরিয়ে দেবে কিনা, তা অনিশ্চিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ফিরে আসাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অপহরণের নেপথ্য কারণ উদঘাটন করা হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, আজ পর্যন্ত অপহরণের পেছনে কারা জড়িত তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার দূরে থাক, শনাক্ত পর্যন্ত করতে পারেনি। অপহৃতরাও আর মুখ খোলেনি।
বিগত বছরগুলোতে অপহরণের হার এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। কে কখন অপহরণের শিকার হবে, এমন আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর মূল কারণ অপহরণকারীদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করতে না পারা। বিষয়টি এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, অপহরণকারীরা ইচ্ছা করলে যে কাউকে অপহরণ করে নিয়ে যেতে পারে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখতে পারে আবার তাদের মর্জি মতো ফিরিয়েও দিতে পারে। ভয়াবহ এসব ঘটনা নিরসনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেন কোনো ভূমিকাই নেই। অপহৃতদের পরিবার থানায় জিডি করতে গেলে অনেক সময় তাদের হয়রানির শিকার হতে হয় বা আশ্বাস দেয়া হয় খুঁজে বের করার। তারপর আর কোনো তৎপরতা থাকে না। অর্থাৎ অপহরণকারীরা এতটাই শক্তিশালী যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের টিকিটি ধরতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে যে জননিরাপত্তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, তা বলা বাহুল্য। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অপহরণের সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। তারা একবার অপহৃত হলে আর কোনো খবর থাকে না। মাঝে মাঝে কারো লাশ পাওয়া যায়। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গত বৃহস্পতিবার অভিযোগ করেছেন, তার দলের প্রায় সাড়ে সাতশ’ নেতা-কর্মী অপহরণের শিকার হয়েছে। তাদের কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অভিযোগও উঠেছে, বিরোধীমত দমনে ‘অপহরণ’ একটি মারাত্মক অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এ অভিযোগ খন্ডাতে হলে অপহরণকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের বিকল্প নেই। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর এখন পর্যন্ত ৫৫ জন গুমের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ফিরে এসেছে ৯ জন (উৎপল দাস ও মোবাশ্বের হোসেনসহ ১১ জন)। মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেছে দুই জনের। সংস্থাটির পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত অপহৃত হয়েছেন ৫৪০ জন। এদের মধ্যে অন্তত: ৩৪৭ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। বাকীদের কারো লাশ পাওয়া গেছে, কেউ কেউ ফিরে এসেছে। অপহরণ বা নিখোঁজ হওয়ার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বরাবরই ‘খোঁজা হচ্ছে’ বলে দায়সারা উত্তর পাওয়া যায়। কখনো কখনো বলা হয়, স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করে আছে। অপহৃতদের পরিবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গিয়েছে বললেও তা আমলে নেয়া হয় না। আমরা বরাবরই বলে আসছি, কেউ যদি আত্মগোপনে বা লুকিয়ে থাকে, তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এ কথা সর্বজনবিধিত, এমন কোনো জটিল কেস নেই যা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমাধান করতে পারে না। বহু জটিল ঘটনাও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে। কেবল অপহরণের ঘটনার ক্ষেত্রে তারা যেন অপারগ হয়ে উঠেছে। আজ পর্যন্ত অপহরণের পেছনে জড়িত কোনো চক্রকেই তারা শনাক্ত বা গ্রেফতার করতে পারেনি। এ ব্যর্থতার জবাব তারা কিভাবে দেবে? আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, অপহরণের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত ও গ্রেফতারে ব্যর্থতার কারণে অপরাধীচক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করে অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। কাকে কখন অপহরণ করতে হবে তা তাদের খেয়াল-খুশির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপহরণের ঘটনার নেপথ্য চক্রকে শনাক্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারার ব্যর্থতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপরই বর্তায়। সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা পোষণ করলে অপহরণের ঘটনা যেমন কমে যাবে, তেমনি অপহৃতরাও উদ্ধার হবে। অপহরণকারী চক্র অপহরণ করে নিয়ে যাবে, তাদের ইচ্ছামতো রাস্তায় ফেলে নিশ্চিন্তে চলে যাবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধরতে পারবে না, এটা হতে পারে না। আমাদের কথা স্পষ্ট, গুরুতর এ অপরাধের পেছনে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এর প্রতিকার না হওয়ায় অপহরণকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রাজনীতিক থেকে শুরু করে শিক্ষক, সাংবাদিক, সাবেক রাষ্ট্রদূত, পেশাজীবীসহ সাধারণ মানুষ পর্যন্ত তাদের অপহরণের শিকার হচ্ছে। এ ধারণা করা অমূলক হবে না, অপহরণকারীদের প্রতিরোধ করা না গেলে জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, তাদের অপকর্মের মাত্রাও বৃদ্ধি পাবে। কাজেই অপহরণের সংস্কৃতির যে বিস্তার ঘটেছে, তা সমূলে উৎপাটন করতে হবে। যারা অপহৃত হয়ে আছে, তাদের উদ্ধারে সরকারকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন ব্যর্থ হচ্ছে, তার নেপথ্যের কারণ উদঘাটন করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন