শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা

| প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশের সড়ক-মহাসড়কের বর্তমান অবস্থাকে শোচনীয় বললেও কম বলা হয়। এমন কোনো সড়ক বা মহাসড়ক নেই, যা মসৃণ যান চলাচলের উপযোগী অবস্থায় আছে। সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো অংশে কার্পেটিং উঠে গিয়ে ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে গেছে। এ ধরনের খানাখন্দে ভরা ও ভাঙ্গাচোরা সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচল শুধু দূরূহই নয়, অত্যন্ত বিপদজ্জনকও। যানবাহনের ক্ষতি ছাড়াও অহরহ দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং যাত্রী বা পথচারি হতাহত হচ্ছে। একই কারণে প্রায় সব সড়ক-মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটসহ জনভোগান্তি চরমে উঠেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর ফতেহপুর অংশে নির্মাণাধীন রেলক্রসিং ওভারব্রিজের জন্য যানজট সর্বক্ষণিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। ৩০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে লাগছে ৫/৬ ঘণ্টা। গত দু’সপ্তাহ ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-টাঙ্গাইল প্রভৃতি মহাসড়কে তীব্র যানজট লেগেই আছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল বড়জোর দেড় ঘণ্টার পথ। অথচ সময় লাগছে ১২/১৪ ঘণ্টা। ঢাকা থেকে রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলের যে কোনো জেলায় যেতে এখন দ্বিগুণেরও বেশী সময় লাগছে। একইভাবে ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-ফরিদপুর, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেট প্রভৃতি মহাসড়কেও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অধিক সময় লাগছে। খানাখন্দ ও ভাঙাচোরা সড়কের কারণে যানবাহন যেমন ধীর গতিতে চলতে বাধ্য হচ্ছে তেমনি অনড় যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকছে। দ্রæত ও নির্বাধ যোগাযোগ ব্যবস্থা যে কোনো দেশের সার্বিক গতিশীলতার প্রমাণ বহন করে। সে বিবেচনায় দেশ, বলা যায়, থেমে আছে, থমকে আছে। এ বাস্তবতা কোনো মতেই মেনে নেয়া যায় না। সড়ক-মহাসড়ক আছে। কোনো কোনো মহাসড়কে চার লেন আছে। কোনো কোনো মহাসড়কের অংশ বিশেষে এর চেয়েও বেশী লেন আছে। অথচ কোথাও যান চলাচল স্বাভাবিক নেই। এর প্রধান কারণ, সড়ক-মহাসড়কগুলো যথাযথ অবস্থায় নেই। কেন নেই, এই প্রশ্নের জবাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই দিতে হবে।
সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য প্রতি বছর বাজেটে বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ থাকে। এ বরাদ্দ কখনো অব্যবহৃত থেকেছে, এমন প্রমাণ নেই। প্রতিবছরই বরাদ্দ ব্যয় হয়ে যায়। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সড়ক-মহাসড়কের এই বেহাল কেন, কেন যান চলাচলে এই প্রতিবন্ধকতা ও জনভোগান্তি? যানজটে আর্থিক ক্ষতিও বিরাট। সে ক্ষতি কে পূরণ করবে? সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থা ও যানজটের কারণে সম্প্রতি ট্রাকভাড়া ৪০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে মালিকরা। এর ফলে পণ্যমূল্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া অবধারিত। এমনিতেই চাল-ডালসহ নিত্যপণ্য সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এমতাবস্থায়, পণ্য পরিবহনে ভাড়া বাড়ার কারণে পণ্যমূল্যে যে বৃদ্ধি ঘটবে, সেটা কে দেবে? বলা বাহুল্য, ক্রেতাসাধারণকেই দিতে হবে। সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়ন ও সংস্কারে বরাদ্দকৃত অর্থের যদি সদ্ব্যবহার হয়, তাহলে এরূপ নাজুক অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। এ অভিযোগ পুরানো, সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়ন ও সংস্কারে বরাদ্দকৃত অর্থের একটা বড় অংশই লুটপাট হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও ঠিকাদার যোগসাজস করে এ অর্থ ভাগাভাগি করে নেয়। কাজ যা হয়, তাও ঠিকমত হয় না। হলে সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়ন ও সংস্কারের পর দু’চার মাস না যেতেই ভেঙ্গেচুরে যাবে কেন? কেনই বা সৃষ্টি হবে খানাখন্দ? ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন কিংবা ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেনের কাজ শেষ হওয়ার অল্পদিনের মধ্যে মহাসড়ক দুটির বিভিন্ন অংশে কার্পেটিং উঠে যাবে কেন? মাদারীপুর-ভুরঘাটা সড়কটি কার্পেটিং করার কিছু দিনের মধ্যেই ভেঙ্গেচুরে যাবে কেন? সরকার অবকাঠোমো উন্নয়ন গুরুত্ব দিচ্ছে। সেটা বুঝা যায়, সড়ক, রেল ও বন্দর উন্নয়নে বিশাল অংকের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ থেকে। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী সড়ক যোগাযোগ মসৃণ রাখার জন্য এ পর্যন্ত অনেক কথাই বলেছেন, অনেক আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেনি। এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা, উন্নয়নের জন্য আধুনিক, গতিশীল ও টেকসই যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। এ জন্য সড়ক, রেল কিংবা বন্দর উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আছে। অবশ্য এসব মেগ প্রকল্পের অধিকাংশই এখনো কথা ও কাগজ-কলমের গন্ডির মধ্যেই আটকে আছে। মেগা প্রকল্প এখনো অধিকাংশই ‘দূরের বাদ্যের’ মত। সে সব যখন হয়, তখন হবে। এক্ষেত্রে চাওয়া শুধু এটুকু যে, প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যেন ঠিক মত হয়, যেন সেগুলো টিকসই হয়। এখন যেটা জরুরি, সেটা হলো, বিদ্যমান সড়ক-মহাসড়কগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা, সব সময় চলাচল উপযোগী রাখা। যা আছে তা রক্ষা করার ও কাজে লাগানোর বিষয়টি সবার আগে। পরের কথা পরে।
পত্রপত্রিকা, টিভি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সড়ক-মহাসড়কের হাল অবস্থা, যানজট ও জনভোগান্তি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রতিদিনই। অথচ এর প্রতিকারের জন্য ত্বরিত ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। যারা প্রত্যক্ষদর্শী ও ওয়াকিবহাল তাদের মতে, সড়ক-মহাসড়কের এবার যে ভগ্নদশা, অতীতে তেমনটি কখনোই দেখা যায়নি। এর একটি কারণ এই যে, এবার বন্যা ও অতিবৃষ্টি হয়েছে অন্যান্য বারের তুলনায় বেশী এবং রাস্তাঘাটের ক্ষতিও হয়েছে ব্যাপক ও অপূরণীয়। এই ক্ষতি মোকাবিলার জন্য আগেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল, দরকার ছিল বর্ধিত অর্থ বরাদ্দের। সড়ক ও জনপথ বিভাগের হিসাবে এবারের বন্যায় দেশের প্রায় দু’হাজার কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়ক মেরামতে জরুরি ভিত্তিতে ১৯৩ কোটি ৪৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা চেয়েছিল বিভাগটি। কাঙ্খিত বরাদ্দের পুরোটা পাওয়া যায়নি। ফলে মেরামত-সংস্কার কাজও সর্বত্র সমানভাবে করা সম্ভব হয়নি। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের সড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশের সড়ক-মহাসড়কের ৬২ শতাংশ জেলা সড়ক। এর ৪৭ শতাংশই ভাঙ্গাচোরা দশায় রয়েছে। এই যখন প্রকৃত বাস্তবতা, তখন জরুরি ভিত্তিতে সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়ন ও সংস্কারের বিকল্প আছে কি? এটা কারো অজানা নেই, চালসহ নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য এবং যাতায়াত ও যোগাযোগের অব্যবস্থা বা দুর্ভোগ রাজনীতিতে সব সময়ই বড় ইস্যু। কারণ এ দুটি ব্যাপারে জনগণ সরাসরি সম্পৃক্ত। সরকারকে গোটা বিষয়টি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্রুত সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়ন ও সংস্কার করতে হবে। যান চলাচল সহজ, মসৃণ, বাধামুক্ত ও নিরাপদ করতে হবে। উন্নয়ন ও সংস্কার অবশ্যই মানসম্মত ও টেকসই হতে হবে। মনে রাখতে হবে, টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন