সউদী আরবে কর্মরত বাংলাদেশী গৃহকর্মীরা অধিক সংখ্যায় দেশে ফিরে আসছে। যারা একদিন ভাগ্য পরিবর্তনের প্রত্যাশায় সেখানে চাকরি নিয়ে গিয়েছিল, তাদের এইভাবে কপর্দকহীনভাবে ফিরে আসা দুর্ভাগ্যজনক। কেন তারা ফিরে আসছে তা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। অপরিসীম অত্যাচার, নির্যাতন, যৌনপীড়ন ও হিংস্রতার শিকার হয়েই মূলত তারা ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা গেছে, জানুয়ারী থেকে এ যাবৎ ১৪৩১ জন মহিলা গৃহকর্মী দেশে ফিরে এসেছে। রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের ফিরে আসার সকল ব্যবস্থা ও বন্দোবস্ত করেছে। রিয়াদ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর জানিয়েছেন, জানুয়ারী থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে ১৬৮১ জনকে দূতাবাসের শেল্টারে এনে রাখা হয়, যাদের মধ্যে ১৪৩১ জনকে দেশে পাঠানো হয়েছে। অবশিষ্টরা ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি ওয়েজ আর্নারস ওয়েলফেয়ার বোর্ডের কাছে তাদের ফেরৎ পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, জেদ্দা কনস্যুলেট অফিসের মাধ্যমেও অনেক ভিকটিম ফেরৎ এসেছে যাদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। কনস্যুলেটে তাদের জন্য একটি সেফ হোম খোলা হয়েছে। বাংলাদেশী প্রবাসী মহিলা শ্রমিক এসোসিয়েশনের তরফে বলা হয়েছে, তারা প্রতি মাসে অন্তত ৩০ জন মহিলা গৃহকর্মীর অভিযোগ পাচ্ছে সউদী আরব থেকে। এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, অনেক মহিলা কর্মী মানসিক রোগী হিসাবে ফিরে আসছে। কখনো কখনো নির্যাতনে মারা যাওয়া মহিলা কর্মীদের লাশও আসছে। নারায়ণগঞ্জের কুলসুম, যে সউদী আরব থেকে ফিরে এসেছে, জানিয়েছে, সে সেখানে সাত মাস গৃহকর্মীর কাজ করেছে। শেষ পর্যন্ত ফিরে এসেছে, অত্যাচার, যৌন নির্যাতন ও অতিরিক্ত খাটুনির কারণে।
সউদী প্রবাসী বাংলাদেশী মহিলা কর্মীদের দেশে ফিরে আসার যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, আগেই বলা হয়েছে, ওয়াকিবহাল মহলের তা অজানা নেই। যখন থেকে বাংলাদেশী মহিলা গৃহকর্মীরা চাকরি নিয়ে সউদী আরব গেছে তখন থেকেই তারা এই বর্বরতার শিকার হচ্ছে। সউদী আরবের সঙ্গে মহিলা গৃহকর্মী পাঠানোর ব্যাপারে সমঝোতা হওয়ার সময়েই অনেকে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, মহিলা কর্মীরা যৌনপীড়নসহ বিভিন্ন প্রকার অপব্যবহারের শিকার হতে পারে। কারণ, অন্যান্য দেশের প্রবাসী গৃহকর্মীরাও সেখানে একই অপব্যবহারের শিকার হয়েছে। শুধু একারণেই ফিলিপাইনসহ কয়েকটি দেশ সউদী আরবে মহিলা গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয় এবং সেখানে কর্মরত মহিলা গৃহকর্মীদের ফেরৎ নিয়ে আসে। এই পটভূমিতেই বাংলাদেশী গৃহকর্মী পাঠানোর সমঝোতা হয় দু’দেশের মধ্যে। যারা সেদিন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন তারা সেটা যথার্থভাবেই করেছিলেন। তাদের সেই সতর্কবাণী ফলতে খুব বেশী দেরী হয়নি। সরকারের উচিৎ ছিল আগেই বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া। মহিলা গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা, মর্যাদা সংরক্ষণ, চাকরিগত সুবিধাসহ অন্যান্য নিশ্চয়তা বিধান করে সেখানে পাঠানো হলে তারা এত অধিক সংখ্যায় বর্বরতা, হিংস্রতা ও বঞ্চনার শিকার হয়তো হতো না। এবারই যে প্রথম তারা ফিরে আসছে, এমনও নয়। আগেও অনেকে একই কারণে ফিরে এসেছে। কিন্তু সরকারের তরফে এর প্রতিকারের তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সেখানে চাকরি করতে গিয়ে মহিলারা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হবে এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
সউদী আরবের অবস্থান সঙ্গত মর্যাদায় মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় শীর্ষে। সে দেশের মুসলমান চাকরিদাতারা মহিলা গৃহকর্মীদের সঙ্গে এ ধরনের অমানবিক ও বর্বরোচিত আচরণ করবে, কোনো বিবেচনাতেই তা মেনে নেয়া যেতে পারেনা। মুসলমান তো দূরের কথা, মানুষ হিসাবে যতটুকু সদাচার তাদের কাছে থেকে আশা করা যায়, ততটুকু সদাচার করতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। মানুষকে তারা মানুষ হিসাবে সম্মান দিতেও নারাজ। ইসলাম নারীদের যে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে তার ধারে কাছেও তারা নেই। অর্থের গরিমা তাদের রীতিমত অমানুষে পরিণত করেছে। অর্থবিত্তশালী সউদী পরিবারগুলো ধরাকে সরাজ্ঞান করে থাকে। তাদের অনাচারী জীবনযাপনের অনেক কাহিনী মানুষের জানা। তারা দুনিয়াকে তাদের ভোগ-বিলাসের ক্ষেত্র হিসাবে গ্রহণ করেছে। অপচয়েরও কোনো শেষ নেই। যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের একাংশ মানবেতর জীবনযাপন করছে তখন তারা বিভিন্ন দেশে প্রাসাদ কিনছে, ক্যাসিনোতে বিনিয়োগ করছে, বিলাসী হোটেল-রেস্তোরা খুলছে, শিল্প ও ললিতকলা এবং ক্রীড়ায় বেহিসাব টাকা ঢালছে, আমোদফুর্তিতে কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয় করছে। তারা প্রতিবছর বিশাল বিশাল অংকের অস্ত্র কিনছে, যুদ্ধের জন্য অকাতরে অর্থ খরচ করছে। এসব ক্ষেত্রে তাদের অর্থের কমতি নেই। মুসলিম বিশ্বের উন্নয়ন, বিশ্ব মুসলিমের কল্যাণে তাদের হাত দু:খজনকভাবে সংকুচিত। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, প্রায় শতবর্ষ আগে তাদের অবস্থা এমন ছিলনা। তেল সম্পদ আবিষ্কারের পর থেকেই শুরু হয় এই রমরমা অবস্থা। সম্পদ যে মানুষের পতনের মূল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সম্পদের প্রাচুর্যই যে সউদী নাগরিকদের বিরাট এক অংশের মানবিক মূল্যবোধ, মানবিক আচরণ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে তা স্পষ্টই প্রতিভাত হয়। তারা আখেরাতের বদলে দুনিয়াকেই বেছে নিয়েছে। কবে তাদের পরিবর্তন আসবে, আল্লাহই ভালো জানেন। পরিশেষে আমরা বলতে চাই, সউদী আরবে প্রবাসী মহিলা গৃহকর্মীদের অত্যাচার-নির্যাতন ও অপব্যবহারের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য সরকারকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সবাইকে ফিরিয়ে আনতে হবে। নতুন করে সেখানে মহিলা গৃহকর্মী পাঠানোর বিষয়টিও পুন বিবেচনা করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন