গত ৬ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের রাজধানী হবে জেরুযালেম ঘোষণা দেওয়ার পর পর সারাবিশ্ব ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রতিবাদে বিক্ষোভ করছে বিশ্ববাসী। এর আগে তাকে সতর্ক করা হয় যে, এই ধরনের ঘটনা ঘটলে তা মধ্যপ্রাচ্য নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে দেবে ও অশান্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু বিশ্ব মোড়লদের নেতা ট্রাম্প কারো কথাই কর্ণপাত করেননি। জবরদখলকারী ইসরাইল জোর করে বছরের পর বছর মুসলমানদের পবিত্র ভূমি দখল করে লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করছে। এই বাস্তবতায় ট্রাম্পের ঘোষণা বিশ্ব মুসলমানদের কলিজায় আঘাত হেনেছে। এরপরও থেমে নেই ইসরইল। গাঁজায় দফায় দফায় বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি বহিনী। এতে ফিলিস্তিনিরা হতাহত হচ্ছে।
ইহুদীদের কেউ ভালো চোখে দেখেনি কোনদিন। ইহুদীরা দীর্ঘদিন ইউরোপে অবস্থান করলেও সেসব দেশে ইহুদীদের কোন গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়নি। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তাদের ‘রক্তচোষা’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন তাঁর নাটকে। এডলফ হিটলার বহু ইহুদীদের গ্যাস চেম্বারে নিয়ে হত্যা করেছিলেন তাদের কূট চরিত্রের কারনে। এসব থেকেই প্রমাণিত হয় তারা উগ্র ও জবরদখলকারী এক নিকৃষ্ট জাতি। পৃথিবীর ইতিহাসে এদের মতো এমন অভিশপ্ত জাতি আর দ্বিতীয়টি নেই। পবিত্র শহর জেরুযালেমের গুরুত্ব মুসলমানদের কাছে অপরসীম। মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস ও মসজিদের শহর জেরুযালেম। ইসরাইল জেরুযালেমকে নিজেদের সম্পত্তি মনে করে। তারা এটাও মনে করে যে, এটা শুধুমাত্র ইহুদীদের। ইহুদীরা বলে, জেরুযালেম ইহুদীদের দ্বারা সৃষ্ট তিন হাজার বছর আগে। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই এলাকায় মানববসতির শুরু ইহুদী জাতির জন্মেরও বহু আগে। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন সেই আদি প্রজন্মগুলোরই অন্যতম প্রধান পুরুষ। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে হেবরন নগরীতে তাঁর কবর আছে এখনও। পবিত্র কুরআন শরীফে সূরা ইমরান, আয়াত ৬৭-তে বলা হয়েছে, ইব্রাহিম (আ.) ইহুদী বা খ্রিস্টান ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক আল্লাহতে আত্মসমর্পণকারী খাঁটি মুসলমান। ইব্রাহিম (আ.) এর সময় ইহুদী ও খ্রিস্টান ধারার শুরুই হয়নি। তখন ইহুদীদের কোন অস্তিত্বই ছিল না। তিন হাজার বছর আগে ইহুদীদের দ্বারা জেরুযালেম সৃষ্টির হিসাবটাই মিথ্যা ও বানোয়াট। জানা যায়, ইহুদী জাতির উৎপত্তি আরো বহুকাল পরে। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর বংশের তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের নবী হযরত ইউসুফ (আ.) এবং তাঁর এগারো ভাইয়ের হাত ধরে। হযরত ইউসুফ (আ.) ও তাঁর এক ভাই বাদে বাকী দশ জন ছিলেন সৎ ভাই। আর এই সৎ ভাইদের থেকেই শুরু হয় ইসরায়েল তথা ইহুদীদের বারো গোত্রের। এটা থেকে প্রমাণ হয় যে ইহুদীজাতি মিথ্যাবাদী ও প্রতারক। ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে পূর্ব জেরুযালেম ইসরাইলের দখলে চলে যায়। তারপর থেকেই পূর্ব জেরুযালেম নিয়ন্ত্রণ করে আসছে ইসরাইল। তবে জেরুযালেমের ওপর ইসরাইলের মালিকানা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও এতোদিন ইসরাইলের দাবির স্বীকৃতি দেয়নি। নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়, ট্রাম্পের নির্বাচনী ফান্ডে ২০ বিলিয়ন ডলার দান করে সাবেক ইসরাইলি ব্যবসায়ী ও ক্যাসিনো বিলিয়নার্স শেলডন জে অ্যাডেলসন শুধুমাত্র মর্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুযালেমে স্থানান্তরের বিনিময়ে।
বিশ্বের শান্তিকামী জনতা আজ ডোনাল্ড ট্রাম্প আর দখলদার ইসরাইলের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছে প্রতিনিয়ত। লক্ষ লক্ষ মানুষ বিক্ষোভে শামিল হয়ে ট্রাম্প আর ইসরাইলকে একঘরে করার শ্লোগান দিয়ে প্রকম্পিত করছে রাজপথ। বিবেকমান মানুষ, মানবাধিকার কর্মী, রাষ্ট্রদূত, রাষ্ট্রনেতারা ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে নিন্দনীয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নোবেলজয়ী খ্রিস্টান ধর্মগুরু এবং মানবাধিকার নেতা ডেসমন্ড টুটু বলেছেন, ‘জেরুযালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের উসকানিমূলক এবং বৈষম্যমূলক ঘোষণায় ঈশ্বর কাঁদছেন। এখন আমাদের দায়িত্ব ট্রাম্পকে এটা বলা যে, তিনি ভুল করেছেন।’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর সমালোচনা করেছেন তুরুস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যকে আগুনের গোলার মধ্যে ঠেলে দেবে বলে সতর্ক করেছেন তিনি। ইসরাইলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কথা বলে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এসকল কূটনীতিকের একটা বড় অংশ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। সাবেক ১১ জন রাষ্ট্রদূতের মধ্যে ৯ জনই জেরুযালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। জেরুযালেমকে ইসরাইলের রাজধানী স্বীকৃতি দেয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা করেছেন উত্তর কোরিয়া। এক বিবৃতিতে জেরুযালেমকে রাজধানী ঘোষণার নিন্দা জানিয়ে উত্তর কোরিয় নেতা কিম জং উন ট্রাম্পকে ‘ভীমরতিগ্রস্ত বৃদ্ধ’ বলে মন্তব্য করেছেন। এদিকে জেরুযালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার প্রতিবাদে মুসলিম কমিউনিটির আহবানে সাড়া দিয়ে কয়েকশ’ মুসলিম হোয়াইট হাউসের সামনে পাটি বিছিয়ে সেখানে জুমার নামায আদায় করে। নামায শেষে মুসল্লিরা বিক্ষোভ করে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। এই প্রতিবাদ সভায় দ্য কাউন্সিল অব আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনস এর নির্বাহী পরিচালক নিহাদ আওযাদ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ‘ট্রাম্প জেরুযালেম এবং ফিলিস্তিনের মালিক নন। তিনি ট্রাম্প টাওয়ারের মালিক। ইসরাইলকে কিছু দিতে চাইলে এটি দিয়ে দিক।’ মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ট্রাম্পকে ‘আন্তর্জাতিক মাস্তান’ ও ‘খলনায়ক’ আখ্যা দিয়েছেন। শেষ কথা হচ্ছে, আলোচনা অনেক হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু কোন সমাধান আসেনি। অনেক আগে মিসরী একজন মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘যে জাতি একটি গরুর বাছুর নিয়ে খোদার সাথে তিন দিন ধরে দেন দরবার করতে পারে তারা যে একটি দেশ, একটি শহর এমনি ছেড়ে দেবে তা কীভাবে বিশ্বাস করা যায়।’ তাই এখন দরকার ইন্তিফাদা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন