বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার কারণে অভিবাসীদের জন্য দুর্দিন চলছে এক দশক ধরে। অভিবাসীদের শ্রমবাজারও সংকুচিত হয়ে পড়ছে। তার পরও বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছে কাজের সন্ধানে। চলতি বছর এ পর্যন্ত ৯ লাখ ৬৩ হাজারের বেশি কর্মী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছে। বছর শেষে এ সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশিদের শ্রমবাজার সংকুচিত না হলেও নিউইয়র্ক ও লন্ডনে দুজন বাংলাদেশি অভিবাসীর জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা বিড়ম্বনা ডেকে আনতে পারে।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের ওপর বাড়ছে গোয়েন্দা নজরদারি। বিশ্বে বর্তমানে অভিবাসীর সংখ্যা ২৪ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা ৭৫ লাখ। বিশ্বে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা পঞ্চম। ভারত, মেক্সিকো, রাশিয়া ও চীনের পরই বাংলাদেশি অভিবাসীদের স্থান। রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান নবম। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ১৯৯০ সালে অভিবাসীরা সেই সময়ের নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় ৭ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। ২০১৬ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারে।
বৈশ্বিকভাবে রেমিট্যান্স এখন সরকারি উন্নয়ন সহযোগিতার তিন গুণেরও বেশি। অভিবাসনের ফলে দক্ষতা, জ্ঞান ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের সুযোগ সৃৃষ্টি করছে, তা উৎপাদন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রেমিট্যান্স আয় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ ভোমরার ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা সত্তে¡ও বাংলাদেশের অর্থনীতি অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে রেমিট্যান্স আয়ের কারণে। তবে অভিবাসন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের এক ক্ষুদ্রাংশ জঙ্গিবাদসহ নানা অপরাধপ্রবণতায় জড়িত হয়ে পড়ার কারণে। বিশেষত যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’র ওপর হামলার পরিকল্পনা আঁটা এবং নিউইয়র্কে আত্মঘাতী হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে দুই বাংলাদেশির গ্রেফতারের ঘটনা ভাবমূর্তির সংকট সৃষ্টি করেছে। অভিবাসন ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
সুখবর হলো, চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসেই জনশক্তি রপ্তানিতে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক গেছে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায়। এ দুটি দেশে শ্রমিক যাওয়ার পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, কাতার, ওমানেও আগের তুলনায় বেশি শ্রমিক গেছে। কিছু নতুন বাজারও সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের শ্রমবাজার আছে এমন কয়েকটি দেশে শ্রমিক যাওয়ার পরিমাণ কিছুটা কমেছেও। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধির এই গতি ধরে রাখতে হলে আরো কার্যকরভাবে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
জনসংখ্যাকে যদি জনসম্পদে রূপান্তর করা যায়, তাহলে শুধু জনসম্পদই একটি দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে পারে। বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশই এই সত্য প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশের ভূখÐ ছোট, জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। অর্থনৈতিক কর্মকাÐও সীমিত। বেকারত্বের হার অনেক বেশি। স্বাভাবিকভাবেই জনশক্তি রপ্তানি আমাদের জন্য অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু এখনো আমরা মূলত অদক্ষ শ্রমিকই রপ্তানি করি বেশি। অথচ বিশ্বে অদক্ষ জনশক্তির চাহিদা ক্রমেই কমে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরির ওপর কিছুটা জোর দেওয়া হয়েছে, তবে তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করা গেলে বিদেশে তাদের উপার্জন বাড়ে, দেশেও তারা অনেক বেশি পরিমাণে অর্থ পাঠাতে পারে। জনশক্তি রপ্তানির সুযোগও বাড়ে। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় অনেক বেড়েছে। প্রথম পাঁচ মাসে শুধু ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.৭ শতাংশ বেশি। আর শুধু নভেম্বর মাসে গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় রেমিট্যান্স বেশি এসেছে ২৮ শতাংশেরও বেশি। আমরা যত বেশি দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করতে সক্ষম হব, আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ তত বেশি হবে।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় তেলনির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। আমাদের জনশক্তি রপ্তানি মূলত মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক হওয়ায় তার প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশের শ্রমবাজারে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ইউরোপেও জনশক্তির চাহিদা কমে গিয়েছিল। এ রকম পরিস্থিতি যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে হতে পারে। তাই যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও আমাদের শ্রমবাজার যেন একটি টেকসই অবস্থান ধরে রাখতে পারে, সে জন্য নানামুখী পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: পরিচালক, এফবিসিসিআই, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন