আজ পয়লা জানুয়ারি, খ্রিষ্টীয় ২০১৮ সালের প্রথম দিন। গতকাল একটি বছরকে পেছনে ফেলে এসেছি আমরা। কালগর্ভে হারিয়ে গেছে ২০১৭ সাল। আমরা জানি, কাল নিরবধি, অবিভাজ্য। তারপরও আমরা কালকে বিভাজন করে নিয়েছি আমাদেরই প্রয়োজনে যাতে নির্দিষ্ট কালপরিধির মধ্যে আমাদের সফলতা ও ব্যর্থতা পরিমাপ করতে পারি। এই মূল্যায়নের দরকার আছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে অগ্রগতির পথে ধাবিত হওয়ার জন্য এটা অপরিহার্য। ২০১৭ সালের হিসাব-নিকাশ ও মূল্যায়নে আমরা বলতে পারি, আমাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বছরটি মিশ্রভাবেই অতিবাহিত হয়েছে। এখানে সাফল্য-ব্যর্থতা দুই-ই আছে। তুলনামূলক বিচারে হয়তো সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি। এতে বিমর্ষ বা হতাশা হওয়ার কিছু নেই। ব্যর্থতাকে সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্য নতুন বছরে আমাদের শক্তি ও সামর্থকে পুর্ণমাত্রায় নিয়োজিত করতে হবে। এটাই আমাদের অঙ্গীকার ও শপথ হওয়া উচিৎ। সন্দেহ নেই, জাতীয় জীবনে আমাদের অনেক স্বপ্ন-প্রত্যাশাই অনর্জিত রয়ে গেছে। নতুন নতুন সংকট-সমস্যাও জন্ম হয়েছে। নতুন বছরে সেগুলো প্রলম্বিত হবে, স্বাভাবিক কারণেই। গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রাণহানি, ফসলহানি আমাদের নানাভাবে বিপর্যস্ত করেছে। দ্রব্যমূল্য সর্বকালের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতি আরও বেহাল অবস্থায় পতিত হয়েছে। বিনিয়োগ-শিল্পায়ন-কর্মসংস্থান বাড়েনি। রফতানী আয়, জনশক্তি খাতের রেমিট্যান্স, রাজস্ব আদায়-সবকিছুই কমেছে। ব্যাংকিই খাত রীতিমত বিপন্নদশায় এসে উপনীত হয়েছে। দুর্নীতি-দুষ্কৃতি ও অর্থপাচার বেড়েছে। এইসঙ্গে নাগরিক নিরাপত্তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। খুন, গুম, অপহরণ, ছিনতাই, রাজাহানি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদের হিং¯্রতাও প্রত্যক্ষ করা গেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। বিরোধীদলের ওপর দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা আরও জোরদার হয়েছে। অপশাসনের দৌরাত্ম্য, বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিস্তৃত হয়েছে। বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের টানাপোড়েন ও বিরোধ বেড়েছে। প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের মতো বেনজির ঘটনাও ঘটেছে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সেদেশের সেনাবাহিনী ও জঙ্গী বৌদ্ধ গোষ্ঠীর গণহত্যা, অত্যাচার ও নির্যাতনে বিশ্বে ব্যাপক প্রতিবাদ, উদ্বেগও উৎকণ্ঠা দেখা দিলেও এটি বাংলাদেশের জন্য বিরাট সমস্যা হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে। অন্তত : ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ বিপুলভাবে প্রশংসিত হলেও এ সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান কবে হবে, কেউ বলতে পারেনা। এখনো রোহিঙ্গারা আসছে। ওদিকে ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদেরও বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। একইভাবে আসামের মুসলমানদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। এটা আগামীতে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে সমর্থন লাভ করলেও ‘নিকট বন্ধুদের’ কাছ থেকে কার্যকর সমর্থন লাভে সমর্থ হয়নি। এটা আমাদের বিদেশনীতির দুর্বলতারই সাক্ষ্য দেয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক দলিল হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যা দেশের জন্য একটা বড় অর্জন। এছাড়া আরও কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থানের অগ্রগতি হয়েছে। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বৈদেশিক সহায়তায় হাতে নেয়া সম্ভব হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গতায়ু বছরে ইতিবাচক- নেতিবাচক নানা ঘটনা ঘটেছে। গেøাবাল ভিলেজের অংশীদার হওয়ার কারণে বাংলাদেশ এসব ঘটনার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত নয়। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরও জটিলতার দিকেই ধাবমান। সেখানে নতুন করে রাজনৈতিক মেরুকরণ হচ্ছে। এর মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়ায় ছেদ রেখা অংকিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কার্যত : এই উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র একঘরে হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তার বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস এর প্রমাণ বহন করে। বিশ্বব্যাপীই ধর্মীয় সম্প্রদায়িক প্রবণতা ও বর্ণবাদী মনোভাব বিস্তার লাভ করেছে, যা আগামী দিনের জন্য অশনি সংকেত। বিশ্বের শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন, সহযোগিতা, সহাবস্থানের পরিবেশ কীভাবে নিশ্চিত হতে পারে, বিশ্ব নেতৃবৃন্দকেই তা ভাবতে হবে এবং এখনই তার উপযুক্ত সময়।
বাস্তবতা যাই হোক, মানুষকে, মানব সমাজকে ও বিশ্বসভ্যতাকে সামনে এগিয়ে নিতে হবে; এর অন্যথা হওয়ার অর্থ কী হতে পারে, সেটা সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও বিকাশের কোনো বিকল্প নেই। একথাটি আমাদের জাতীয় ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। এ বছর নির্বাচনের বছর। জাতির প্রত্যাশা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন। আন্তর্জাতিক মহলও এমন একটি নির্বাচনই কামনা করে। এরকম নির্বাচন রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই সম্ভবপর হতে পারে। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে পরস্পবিরোধী অভিমত রয়েছে, আলোচনার মধ্যদিয়েই তার নিরসন ঘটতে পারে। এখনও প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র অবস্থান মুখোমুখী। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা মূখ্য। নির্বাচনের কাম্য পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। বলা বাহুল্য, এই নির্বাচনের ওপরই রাজনৈতিক অশ্চিয়তা দূর, সহাবস্থানমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের বিকাশ নির্ভরশীল। সুস্থ্য, স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনীতিই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশ, সুশাসন ও সুবিচার নিশ্চিত করতে পারে। নিশ্চিত করতে পারে নাগরিক নিরাপত্তা। আমরা আর রাজনৈতিক বিবাদ, নাগরিক অনিরাপত্তা, গুম, খুন, অপশাসন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখতে চাই না। আমরা চাই শান্তি, স্থিতি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন। আমরা বিশ্বাস করি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে, রাজনীতি সুস্থ্য ধারায় ফিরে এলে অর্থনীতি ও জনজীবনধারায় সুবাতাস প্রবাহিত হবে। সকল অনিশ্চয়তা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও অপশাসনের অবসান ঘটবে। চলতি বছরে সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে দেশের মানুষের এটাই প্রত্যাশা যে, তারা শুভবৃদ্ধির পরিচয় দেবে। আগামী দিনগুলো আমাদের সকলের জন্য কল্যাণময় ও নিরাপদ হোক, এই কামনা করি। পরিশেষে খ্রিষ্টীয় নববর্ষে সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন