নতুন বছরে সরকারের জন্য অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এটা নির্বাচনের বছর হওয়ায় একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান তার মধ্যে অবশ্যই প্রধান ও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গত বছর সার্বিক বিবেচনায় অর্থনীতি খুব ভালো অবস্থায় ছিল না। অর্থনীতিকে আরও গতিশীল ও নিরাপদ করার চ্যালেঞ্জ মোটেই কম বড় চ্যালেঞ্জ নয়। এইসঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অর্থপাচার, ব্যাংকিংখাতে ধস, মানবাধিকার লংঘন, গুম, বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড, দুর্নীতি, শিক্ষার নিম্নমান ও প্রশ্নপত্র ফাঁস, বিনিয়োগ বন্ধ্যুাত্ব, বেকারত্ব, ধনী-গরীব বৈষম্য ইত্যাদির মতো সমস্যাগুলোও রয়েছে। এসব সমস্যা গত বছরও ছিল, এ বছরও থাকবে এবং যথেষ্ট ভোগাবে বলেই পর্যবেক্ষকদের ধারণা। বিগত চার বছরে তেমন কোনো রাজনৈতিক উত্তেজনা ছিল না। পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল ছিল। এই আপাত স্থিতিশীলতা এ বছর থাকবে না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠবে। নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সমস্যা অনেক দিন ধরেই আছে। সেটা আরও জটিল আকার নিতে পারে। নতুন করে সংঘাত-সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে, এমন আশংকা অনেক আগেই ব্যক্ত করেছে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক মহল। সরকারের দায়িত্ব দেশকে এই আশংকার বাইরে রাখা এবং একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। সমস্যা যেখানে আটক আছে, সেখান থেকে তা ছোড়াতে রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতা অপরিহার্য। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অবস্থান এক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী এবং এখন পর্যন্ত তারা স্ব স্ব অবস্থানে দৃঢ় রয়েছে। তাদের অনড় অবস্থান এবং সে কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির, অনিশ্চিত ও সংঘাতময় হয়ে উঠলে গণতন্ত্র ও নির্বাচন গভীর খাদে গিয়ে পড়তে পারে। আর এরকম অবস্থায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়ন ও অর্থনীতি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে উন্নয়ন ও অর্থনীতির গতি তরান্বিত হতে পারে না। অনেকেই আশংকা করছেন, অর্থনীতিতে যে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, তা উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যেমন দরকার তেমনি দরকার বিশেষ উদ্যোগ বা পদক্ষেপ।
রোহিঙ্গা সমস্যা, বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রতিবেশী মিয়ানমারের চাপিয়ে দেয়া একটি সমস্যা। গণহত্যা ও গণনির্যাতনের মুখে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের আশ্রয়, খাদ্য ও নিরাপত্তা দিয়ে বাংলাদেশ যে মানবিক ঔদার্যের পরিচয় দিয়েছে, তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হলেও এ সমস্যার একমাত্র সমাধান নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাসহ মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসন। সমস্যাটি দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশ আরও নানারকম সমস্যার মুখে পড়বে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বটে, তবে এর রোডম্যাপ যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা মুশকিল। কারণ, অতীতেও দেশটি কথা দিয়ে কথা রাখেনি। এমতাবস্থায়, সরকারকে আঁটঘাট বেধেই চলমান প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন, যা সফল কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারে। সমস্যাটির সমাধান অনিশ্চিত কিংবা দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশকে কড়া মাসুল গুনতে হবে। গত বছর দফায় দফায় বন্যায় ব্যাপক ফসলহানির কারণে চালের মূল্যে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। গত বছর শেষ দিন পর্যন্ত মোটা চাল ৫৫ এবং মাঝারি মানের চাল ৭০ টাকা কেজি ধরে বিক্রী হয়েছে। অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামও আকাশছোঁয়া। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতাও নি:শেষ প্রায়। এ অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন কীভাবে ঘটবে, সরকারকেই তা বের করতে হবে। বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। আর তার জন্য দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য। তাছাড়া শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক অবস্থার ওপর বিনিয়োগ, শিল্পস্থাপন, বাণিজ্যবিকাশ, কর্মসংস্থান ইত্যাদিও নির্ভরশীল।
দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত সংগীন। নাগরিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বলতে কিছু নেই। খুন, গুম, অপহরণ, বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড, সন্ত্রাস, ছিনতাই, চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্যে মানুষ সর্বদাই শংকা-আতঙ্ককের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। কে কখন গুম বা অপহরণের শিকার হবে, পথে প্রান্তরে লাশ হয়ে পড়ে থাকবে কিংবা চিরদিনের জন্য নিখোঁজ থেকে যাবে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। গত বছর অন্তত ৯১ জনকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যাদের বেশির ভাগেরই কোনো খোঁজ নেই। কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেছে এবং কয়েকজন ফিরে এসেছে। এরকম পরিস্থিতিতে কোনো মানুষের পক্ষেই স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। নাগরিক নিরাপত্তার এই শোচনীয় পরিস্থিতির জন্য সুশাসনের অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিই মূলত: দায়ী বলে মনে করে নাগরিক সমাজ। একটি দেশে যখন সুশাসন থাকে না, সুবিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে না তখন সে দেশে কোনো কিছুই ঠিকমত চলে না। শাসনের নামে চলে দু:শাসন। সেই সঙ্গে ফ্রি স্টাইলে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তাচার। আমরা নতুন বছরে আর এসব দেখতে চাইনে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন, গণতন্ত্রায়ন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, শান্তি, নিরাপত্তা এবং মানবিক ও অর্থনৈতিক বিকাশই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাই মুখ্য ও অগ্রগণ্য। সরকার তার সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম ও সমর্থ হোক, এটাই আমরা কামনা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন