দেশের হাজার হাজার কিলোমিটার সড়ক মহাসড়কের বেহাল অবস্থা। সীমাহীন যানজট ও দুর্ঘটনার ঝক্কি নিয়ে চলছে সড়ক পথের গণপরিবহন ও সাধারণ পরিবহন। এহেন বাস্তবতায় ক্রমেই নির্ভরশীলতা বাড়ছে রেলের উপর। দেশের রেলপরিবহন ব্যবস্থা নানাবিধ সংকটে থাকলেও সড়কপথের ভোগান্তি ও ঝুঁকি এড়িয়ে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী পরিবহন হিসেবে রেলের জনপ্রিয়তা বাড়ার পাশাপাশি এর আয় বৃদ্ধি পেলেও রেলের বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছেনা সরকার। স্বাধীনতার পর গত ৪৬ বছরে নতুন নতুন সড়ক মহাসড়ক নির্মানে, উন্নয়নে ও সংস্কারে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও রেলের সম্ভাব্য সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের কোন পদক্ষেপই কার্যকর হয়নি। অথচ বিদ্যমান রেলব্যবস্থার উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন করা হলে দেশের মূল্যবান হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমির সাশ্রয় হতো। যত্রতত্র রাস্তা নির্মান, ব্রীজ কালভার্ট নির্মানে জনগনের ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার মধ্য দিয়ে একদিকে কৃষিজমির অপচয় হয়েছে, অন্যদিকে অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে দেশে পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। বিপুল ব্যয়ে রাস্তা নির্মানের পর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তা ভেঙ্গে দুর্গম ও ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। অথচ রেলব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় ও অপচয় অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব ছিল।
ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ঔপনিবেশিক শাসনে বৃটিশদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সোপান হয়ে উঠেছিল রেলপথ। ইংল্যান্ডে যোগাযোগের অন্যতম নেটওয়ার্ক হিসেবে রেলপথ গড়ে তোলার পর বৃটিশ কলকারখানার জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ, বিপণন এবং শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে ভারত-বাংলাদেশসহ উপনিবেশগুলোতেও রেলপথ গড়ে তোলা হয়। বৃটিশরাই প্রথম বলেছিল সমৃদ্ধি নাকি রেলপথ ধরেই আসে। শতবছরের পুরনো সেই আপ্তবাক্য এখনো সমানভাবেই মেনে চলেছে বৃটিশ ও পশ্চিমা দুনিয়া। এমনকি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে চীন ও ভারতের মত এশিয়ার উদিয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার ভিত্তি গড়ে উঠেছে রেলপথের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে। চীনের রেলপথ এখন বিশ্বের যে কোন উন্নত রাষ্ট্রের জন্য ঈর্ষনীয় বিষয়। রেলপথের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে চীন সরকার। পাশের দেশ ভারতের স্থল যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে রেলপথের উপর নির্ভরশীল। আভ্যন্তরীণ কৃষি ও শিল্পপন্য উৎপাদন, বিপণন, বাজারজাতকরণ ও আমদানী রফতানীতে সবদেশেই রেলপথ সবচে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী হিসেবে গণ্য। আমাদের সমুদ্রবন্দরগুলোর সাথে সারাদেশের রেলযোগাযোগের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন সম্ভব হলে আমদানী রফতানীতে বিদ্যমান ঝুঁকি ও ব্যয় অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। রেলের উন্নয়নের অপরিহার্য প্রকল্প বাস্তবায়নের চাইতে সড়কপথ ও সড়ক পরিবহনের উন্নয়নেই যেন সরকারের সংশ্লিষ্টদের আগ্রহ বেশী। সড়ক পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিক ও ইউনিয়নের স্বার্থেই যেন রেলের উন্নয়ন পরিকল্পনা থেমে আছে।
নানাবিধ সমস্যা ও সংকটে স্থবির হয়ে আছে আমাদের রেলপরিবহন ব্যবস্থা। রেলের প্রয়োজনীয়? ইঞ্জিন ও বগি সংগ্রহ, যাত্রি পরিষেবা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার দাবী বহুদিন ধরেই উচ্চারিত হচ্ছে। বিশেষত রেলের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল নিয়োগের বিষয়টি বছরের পর বছর ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছেনা। যেখানে পাকিস্তান আমলে রেলের জনবল ছিল ৫০ হাজারের বেশী সেখানে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর সে সংখ্যা ৩০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুনের বেশী ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিধি ১০গুনের বেশী সম্প্রসারিত হলেও রেলপথের আয়তন ও প্রকৃতি সঙ্কুচিত হয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও এমন বৈপরীত্য চোখে পড়েনা। আমরা শিল্প ও রফতানী বাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলছি অথচ রেলপথব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে সড়কপথ ও সড়ক পরিবহনের বিপুল অপব্যয়কেই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছি। সড়ক পরিবহনে বিপুল ব্যয় ও নির্ভরশীলতার ধারাও অবশেষে ব্যর্থ হয়েছে। মানুষ শেষ পর্যন্ত রেলপথের উপরই আস্থা রাখতে চায়। শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও রেলপথে যাত্রি ও পন্য পরিবহন এবং এ পথে আয় দ্রুত বেড়ে চলেছে। প্রয়োজনীয় উন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে রেলপথের সম্ভাবনা দেশের অর্থনীতিকে বহুদুর নিয়ে যেতে পারে। রেলের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে রেলের জন্য উন্নত দ্রুতগামি ইঞ্জিন, আরামদায়ক ও আধুনিক প্রযুক্তিগত সুযোগ সুবিধা সম্বলিত বগি সংগ্রহ এবং হাজার হাজার দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। দেশের সব সমুদ্র স্থল বন্দর, বিভাগীয় শহর, জেলা-উপজেলা ও গুরুত্বপূর্ণ জনপদকে রেলপথ নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত করতে হবে। রেলপথের উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সমুহ যথাশীঘ্র দূর করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন