কোন বালকের যদি ১৪ বছর বয়সেও অন্ডোকোষের আয়তন ৪ মিলিমিটারের বেশি না হয়, অথবা অন্ডোকোষের অনুপস্থিতি থাকে; আবার কোন বালিকার ১৩ বছর বয়সেও যদি স্তন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত না হয় এবং উভয়ের ক্ষেত্রে বয়োঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন অনুপস্থিত থাকে, তাহলে বালকের ক্ষেত্রে ১৪ বছরের পর এবং বালিকার ক্ষেত্রে ১৩ বছর পর বিলম্বিত বয়োঃসন্ধি বলা হবে। এ সময়ের মধ্যেই ৯৫% শতাংশ বালক-বালিকার যৌবন প্রাপ্তি শুরু হয়।
প্রকারভেদ ঃ প্রাইমারি হায়পারগোনাডোট্রপিক হায়পোগোনাডিজমঃ অন্ডোকোষ বা ডিম্বাশয়ের সমস্যা এর মূল কারণ।
এক্ষেত্রে গোনাড ঃ (অন্ডোকোষ বা ডিম্বাশয়) প্রয়োজনীয় যৌন হরমোন তৈরিতে ব্যর্থ হয়। এর পিছনে ক্রমোজোমাল ত্রæটি (টার্নার সিনড্রোম, ক্লিনেফিল্টার সিনড্রোম ইত্যাদি) এর হাত থাকতে পারে। আবার টেস্টেস্টেরন হরমোনের ত্রæটিও থাকতে পারে। খুব কম করে হলেও, কিছু কিছু বালক-বালিকার এক্ষেত্রে এটি ঠিকমত তৈরিই হয় না। আবার শৈশবে বালকটি যদি অন্ডোকোষে বড় ধরণের কোন আঘাত পায় বা অন্ডোকোষটি ফেলে দেবার মতো ঘটনা ঘটে তাহলেও যৌবন প্রাপ্তি প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। শৈশবে ছেলেদের অন্ডোকোষের প্রদাহ বা মেয়েদের ডিম্বাশয়ের প্রদাহ যৌবন প্রাপ্তিতে বিঘœ ঘটাতে পারে। ক্যান্সার ক্যামোথ্যারাপি বা রেডিও থ্যারাপি অনুরূপ সমস্যা তৈরি করতে পারে। থ্যালাসেমিয়া বা অন্য কোন কারণে যাদের ঘন ঘন রক্ত নিতে হয়, তাদের গোনাডে অতিরিক্ত আয়রন জমে কার্যকারীতা হ্রাস পেতে পারে। এরপরেও কিছু কিছু কারণ অজানা থেকে যায়।
হায়পোগোনাডোট্রপিক হায়পোগোনাডিজমঃ হায়পোথ্যালামাস বা পিটুইটারিতে প্রধান সমস্যাটি থাকে।
সাময়িক বা কিছু মাস বা বছরের জন্য এ ঘটনা বিরাজ করতে পারে। এর মধ্যে পারিবারিক বা বংশধারা একটি প্রভাব প্রকটভাবে বিরাজ করতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে অপুষ্টিজনিত দৈহিক বৃদ্ধিহীনতাও এর একটি কারণ হতে পারে। তাছাড়া বাড়ন্ত বয়সে অসংক্রামক রোগ ও দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক রোগের কারণেও এরকম সমস্যা হতে পারে। শৈশবকালে মাত্রাতিরিক্ত শারীরিক শ্রম বা ব্যয়াম করলে বিলম্বিত বয়োঃসন্ধি হতে পারে।
আবার এ সমস্যাটি স্থায়ীও হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রজনন হরমোনের ঘাটতি প্রধান কারণ। কলমেন সিনড্রোম, প্র্যাডার উইলি সিনড্রোম, প্যানহায়পো পিটুইটারিজম ইত্যাদি। আবার কুসিং সিনড্রোমও কারো কারো থাকতে পারে।
বিলম্বিত বয়োঃসন্ধিকালে বালক-বালিকারা প্রধানত তাদের বাবা-মার সাথে হরমোন বিশেষজ্ঞ বা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে হাজির হন। অভিভাবকরা তাদের ছেলে-মেয়েদের যৌবন প্রাপ্তি না হওয়ায় দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হন এবং চিকিৎসককে তা জানান। এ ছেলে-মেয়েদের অধিকাংশেরই দৈহিক উচ্চতা কাঙ্খিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম থাকে। রোগী নিজে বা অভিভাবকরা সুনির্দিষ্টভাবে কোন সমস্যা উপস্থাপন নাও করতে পারেন; বিশেষ করে ছেলেদের ক্ষেত্রে। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে শারীরিক অন্যান্য পরিবর্তনের সাথে সাথে ঋতু¯্রাব শুরু না হওয়াটা নজরে পড়তে পারে। তবে বালক-বালিকা উভয়ের ক্ষেত্রে বয়োঃসন্ধিকালে প্রবেশে সকল পরিবর্তন অনুপস্থিত থাকে। ছেলেদের দাড়ি-গোফ গজায় না, দৈহিক গঠনের পুরুষালী ভাব হয় না, লিঙ্গের আকার ছোট থাকে, লোম ও ঘামের কাঙ্খিত পরিবর্তনও অনুপস্থিত থাকে। অন্ডোকোষ মাপলে ৪ মিলিমিটারের কম পাওয়া যায়। বালিকাদের ক্ষেত্রেও স্তনের বৃদ্ধি হয় না, দেহের নারীসুলভ অন্যান্য পরিবর্তন অনুপস্থিত থাকে, যেমন- নিতম্বের আকার পরিবর্তন, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন ইত্যাদি। উভয় ক্ষেত্রেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের ঘাটতি থাকবে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষাঃ প্রথমেই বর্তমানে বালক বা বালিকাটির দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছে কি না, সেটি নিশ্চিত হতে হবে। এ ধরণের রোগ অনেক থেকেই বালক বা বালিকাটির দেহে বসবাসে সম্ভাবনা আছে। এর পর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বিশেষ করে বাবা বা ভাইয়ের দৈহিক বৃদ্ধির সাথে সমন্বয় করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিকল্পনা শুরু করতে হবে। বয়োঃসন্ধিকালের লক্ষণগুলোর অনুপস্থিতি পরিমাপের জন্য পৃথিবী ব্যাপী স্বীকৃত পদ্ধতি হলো-ট্যানার স্ট্যাজিং (ঞধহহবৎ ঝঃধমরহম)। বালক বা বালিকার দৈহিক উচ্চতার পরিমাপ অবশ্যই নিতে হবে। রক্তের গ্রোথ হরমোন মাপলে অনেক সময় কম পাওয়া যেতে পারে; গøুকোকর্টিকয়েড মাপলে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে । দেহের উপর ও নীচের অংশের অনুপাতও জেনে নিতে হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোর মধ্যে রক্তের টেস্টোস্টেরণ (ছেলেদের জন্য), এলএইচ, এফএসএইচ, স্ট্রোজেন ইত্যাদির মাত্রা দেখে নিতে হবে (সকালবেলার নমুনায়)।
অধিকাংশ বিলম্বিত বয়োঃসন্ধির বালক-বালিকাদের ধীর গতিতে দৈহিক বৃদ্ধি হয় এবং তা একটু দেরিতে হলেও অনেকটা স্বাভাবিকের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা বেশি ঘটে।
টার্নার সিনড্রোমের বাচ্চারা অন্য অনেক লক্ষণের সাথে বেঁটে আকার নিয়ে উপস্থিত হবে। ক্লিনেফিল্টার এর বাচ্চারা লম্বা আকৃতির হবে। ক্যারিও টাইপিং করে খুব সহজেই ক্রমজোমালের ত্রæটিগুলো সনাক্ত করা সম্ভব হয়।
চিকিৎসাঃ রোগ সনাক্ত করে, সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। পারিবারিক ধীর গতির বৃদ্ধি সম্বলিত ছেলে-মেয়েদের একটু পরে হলেও বয়োঃসন্ধিকাল অতিক্রম করার বা যৌবন প্রাপ্ত হবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। দীর্ঘ স্থায়ী রোগ যাদের আছে, তাদের ক্ষেত্রেও যথাপোযুক্ত চিকিৎসায় যৌবন প্রাপ্তির সহায়ক হবে। কিন্তু ক্রমোজোমাল ত্রæটি থাকলে, সেক্ষেত্রে ফলাফল খুব আশাব্যাঞ্জক হবে না। তাদের জন্য সাপোর্টিভ বিভিন্ন রকম ব্যবস্থা নিতে হবে।
ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা।
মোবাইল নং ০১৯১৯০০০০২২
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন