৫ জানুয়ারি পাল্টাপাল্টি সমাবেশ-কর্মসূচি ঘিরে বছরের শুরুতে আবারো দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিরোধী দল বিএনপি’র বর্জন ও প্রতিহত করার কর্মসূচির মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শুরু থেকে অদ্যাবধি প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপিসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করেছিল। বেশীরভাগ আসনে কোন প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী না থাকায় বিনাভোটেই ১৫৩জন এমপি নির্বাচিত হন। যে সব আসনে ভোট হয়েছিল সেখানেও ভোটার উপন্থিতি ছিল নামমাত্র। এহেন বাস্তবতায় সরকারীদল ও সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনকে একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আখ্যায়িত করে বিরোধিদলের সাথে আলোচনাসাপেক্ষে যথাশীঘ্র আরেকটি নির্বাচন আয়োজনের কথা বলা হয়। সে নির্বাচন হয়নি। পরবর্তীতে বলা হয়, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখেই প্রতি বছর ৫ জানুয়ারী পালিত হচ্ছে বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে। ক্ষমতাসীন আওয়ামিলীগ দিনটিকে গণতন্ত্রের বিজয় এবং বিএনপি গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে এ দিন কর্মসূচি দিয়ে থাকে। এবারেও ৫ জানুয়ারীকে নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বিপরীতমুখী অবস্থানকে ঘিরে দেশের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূতিতে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারী উপলক্ষে বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচি ঠেকাতে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করলে বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রায় তিনমাস ধরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক মহাসড়ক অবরুদ্ধ করে রাখে। সে সময়ের নাশকতা ও সড়ক-মহাসড়কে আগুন সন্ত্রাসের অভিযোগে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে সরকার। প্রথমত: নাশকতার মামলাগুলোর বেশীরভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রতিয়মান হয়েছে। সারাদেশে অসংখ্য নাশকতার ঘটনার সাথে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। সরকার ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও বৈরিতার কারণে সবচে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষ ও অর্থনীতি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকারের মেয়াদ ৪ বছর অতিক্রান্ত করেছে। নাশকতার অজুহাত দেখিয়ে সরকার বিএনপিকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাঁধা দিলেও গত বছরের শেষ দিকে বিএনপি বেশ কয়েকটি শান্তিপূর্ণ ও সফল কর্মসূচি পালন করেছে। চিকিৎসার জন্য তিনমাস বিদেশে থাকার পর খালেদা জিয়ার দেশে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বিমানবন্দর সড়কে বিএনপি’র শো ডাউন, বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলেক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশ, রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন উপলক্ষে ঢাকা-চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়কে জমায়েতসহ এসব কর্মসূচির প্রতিটি শান্তিপূর্ণভাবেই পালিত হয়েছে। এসব কর্মসূচি পালনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকা এবং দলীয় নেতাকর্মীদের শান্তি-শৃঙ্খলা প্রশংসিত হয়েছে। এতে বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়েছে, পুলিশ বাধা না দিলে, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করলে, সংঘাতের আশঙ্কা তেমন থাকে না।
এবারের ৫ই জানুয়ারীতে বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ কর্মসূচি পালনের আবেদন করেছে। পাশাপাশি আওয়ামীলীগও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে দুইটি সমাবেশ করার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তবে আওয়ামীলীগের কর্মসূচি পালনে কোন বাঁধা না থাকলেও গতকাল পর্যন্ত বিএনপিকে অনুমতি দেয়নি পুলিশ। অখ্যাত একটি রাজনৈতিকদলকে ৫ জানুয়ারী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। এমনকি বিএনপি’র বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার অনুমোদনও গতকাল বিকাল পর্যন্ত দেয়নি পুলিশ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সভা সমাবেশ করা যে কোন বৈধ রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার অবারিত রাখা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অন্যতম অঙ্গ। মেয়াদের শেষ বছরে এমনিতেই সরকারের সামনে বেশ কিছু রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ও আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং একটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার তাগিদ অগ্রাহ্য করার কোন সুযোগ নেই। স্থিতিশীল পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা পুলিশের দায়িত্ব। কোন বড় রাজনৈতিক দলকে সভা সমাবেশ করতে না দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলা পুলিশের জন্য শোভন নয়। চলতি বছরের শেষদিকে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বছরের শুরু থেকেই একটি শান্তিপূর্ণ, সহাবস্থান ও সমঝোতামূলক পরিবেশ গড়ে তুলতে সকল পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাজনৈতিক দলগুলো আবারো ব্যর্থ হলে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। দীর্ঘমেয়াদে দুর্ভোগের শিকার হবে দেশের সাধারণ মানুষ। বড় দুইদলের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ সফল করার নজির সাম্প্রতিক সময়েও রয়েছে। মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেশ ও জনগণের জন্য অপরিহার্যই কেবল নয়, জরুরিও বটে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন