নগরায়ণের এ যুগে ইটের প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করা যায় না। সুউচ্চ ভবন, দালান-কোঠা, রাস্তা-ঘাট নির্মাণে ইটের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। এই অপরিহার্যতাকে পুঁজি করে ইট উৎপাদনে যেমন একের পর এক ইটভাটা গড়ে উঠছে, তেমনি এসব ইটভাটা কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই যত্রতত্র স্থাপন করা হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বেশিরভাগ ইটভাটাই গড়ে উঠছে কৃষিজমিতে এবং লোকালয়ের আশপাশে। এতে কৃষিজমি কমে যাওয়া থেকে শুরু করে ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় পরিবেশ-প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। রাজধানীর আশপাশের অঞ্চলে তো বটেই সারা দেশেই কৃষি জমিতে আইনের তোয়াক্কা না করে অপরিকল্পিতভাবে জালের মতো ইটভাটা গড়ে তোলঅ হয়েছে এবং হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও এসব দেখভাল করার দায়িত্ব নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের কোনো টনক নড়েনি। আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং নিয়ম না মানার কারণে কৃষিজমিতে ইটভাটা গড়ে উঠা বন্ধ করা যায়নি এবং আশপাশের পরিবেশও ক্ষতির সম্মুখীন ঠেকানো যাচ্ছে না। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই কৃষিজমিতে ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এতে ফসল উৎপাদনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে এবং পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। শুধু চট্টগ্রামেই নয়, আমরা যদি ঢাকার চারপাশের এলাকাগুলোর দিকে দৃষ্টি দেই তবে দেখা যাবে, অসংখ্য ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এসব ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি করে চলেছে। এর কোনো প্রতিকার নেই।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ অনুযায়ী, কৃষিজমিতে ইটভাটা স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়া আবাসিক এলাকা থেকে এক কিলোমিটার এবং ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়ক থেকে অন্তত আধা কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, কৃষিজমি ও অপরিকল্পিতভাবে ইটভাটা স্থাপনের ক্রমবর্ধমান দৌরাত্ম বন্ধে আইনটি করা হলেও এর প্রয়োগ যেমন হচ্ছে না, তেমনি ভাটা স্থাপনকারীরাও তা মানছে না। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সংশ্লিষ্ট এলাকার ফসল উৎপাদন ও পরিবেশের উপর পড়ছে। আইন অমান্য করে যেখানে সেখানে ইটভাটা স্থাপনের লাগাম যদি টেনে ধরা না যায়, তবে কৃষি ও পরিবেশের কী পরিমাণ ক্ষতি হবে তা অননুমেয় নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে এক শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। নদীভাঙন এবং বসতবাড়ি, রাস্তা-ঘাট ও অবকাঠামো নির্মাণ মূলত এরজন্য দায়ী। খাদ্য সংকট মোকাবেলা এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে যেখানে কৃষিজমি সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই, সেখানে যথেচ্ছভাবে কৃষিজমি কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অনেকাঞ্চলে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, দুই ফসলের জায়গায় এক ফসল হচ্ছেÑএ অবস্থায় বিদ্যমান কৃষিজমির যতœ ও সংরক্ষণের পাশাপাশি অনাবাদি জমিকে চাষযোগ্য করে তোলা জরুরী। অপরিকল্পিতভাবে কৃষিজমিতে ঘরবাড়ি, স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। নগরায়ণের বিষয়টি অস্বীকার করা না গেলেও তা পরিকল্পিতভাবে করা প্রয়োজন। দেখা যাচ্ছে, যে যেভাবে পারছে সেভাবেই নগরায়ণ করে চলেছে। এই নগরায়ণে ইটের যোগান দিতে গিয়ে আইনের তোয়াক্কা না করে কৃষিজমিসহ লোকালয়ের আশপাশে ইটভাটা গড়ে তোলা হচ্ছে। রাজধানী থেকে বের হওয়ার পথে সাভার, আশুলিয়া, কেরানীগঞ্জ, বুড়িগঙ্গার তীরসহ আশপাশের এলাকায় দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে অসংখ্য ইটভাটা। ইটভাটা থেকে নিঃসরিত বিষাক্ত ধোঁয়া আশপাশের এলাকার পরিবেশ দূষিত করে চলেছে। এসব ইটভাটার কয়টির যথাযথ অনুমোদন রয়েছে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। নগরায়ণের ক্ষেত্রে ইটের বিকল্প নেই বললেই চলে। তার অর্থ এই হতে পারে না, কৃষিজমি ও পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করে ইট উৎপাদন করতে হবে। এর জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা প্রয়োজন। একদিকে ইটভাটাও স্থাপন করতে হবে, অন্যদিকে তা যাতে কৃষিজমি ও পরিবেশের ক্ষতি না করে, সেদিকেও কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের দেশে ইট তৈরিতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা হয়। বিপুল সংখ্যক এই কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়েও দেখা গেছে আশপাশের বন উজার হয়ে যাচ্ছে। গাছপালা কেটে ভাটায় ব্যবহারের ফলে পরিবেশ বিরান হয়ে যাচ্ছে। আবার ভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড, মনোঅক্সাইডের মতো বিষাক্ত উপকরণ থাকায় চারপাশের পরিবেশ ও ফসলাদি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এলাকায় বসবাসকারি মানুষজনও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ইটভাটার এসব ক্ষতিকর দিক বছরের পর বছর ধরে চললেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদাসীন হয়ে রয়েছে।
নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও কৃষিজমি ও লোকালয়ে ইটভাটা স্থাপন আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই নিষেধাজ্ঞা ও আইন অমান্য করে যারাই ইটভাটা স্থাপন করছে, তাদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি সেসব ইটভাট উচ্ছেদ করতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মাঠপর্যায়ে জরিপ করে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইটভাটা অনুমোদন দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সরেজমিনে পরিদর্শন করে অনুমোদন দেয়ার প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, কৃষিজমি বাঁচাতে হবে এবং পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। ইটভাটায় কাঠের ব্যবহারের পরিবর্তে পরিবেশ বান্ধব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। উন্নত বিশ্বে কাঠের পরিবর্তে বৈদ্যুতিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। পরিবেশ রক্ষার্থে এ পদ্ধতি আমাদের দেশেও অবলম্বন করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখা দরকার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন