আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এরাই নেতৃত্ব দেবে আগামীতে- হয়ে উঠবে আগামী দিনের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিক ইত্যাদি। তাই তাদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করা অত্যন্ত জরুরি। রাস্তায় জন্ম এবং রাস্তাতেই যারা বসবাস করে তাদের আমরা পথশিশু বলে থাকি। যে সকল শিশুর পিতা-মাতা নেই অথবা মা তালাকপ্রাপ্তা, বাবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, মাদকাসক্ত কিংবা অসচ্ছল সে সব পরিবারের শিশুই পারিবারিক বন্ধন থেকে ছিটকে পড়ে। বাধ্য হয়েই এরা রাস্তায় নামে। রাস্তায় জীবনযাপন করার মাধ্যমে পরিচিতি পায় পথশিশু হিসেবে। জন্মের পর থেকেই পথশিশুরা জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। রোদ-বৃষ্টি, গরম-শীত এদের কাছে সমান। পরনে কাপড় আছে কি নেই তা তাদের কাছে মুখ্য নয়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মায়ের হাতের মজাদার খাবার দিয়ে নাস্তা করার পরিবর্তে মানুষের বকুনি খায়। যখন অন্য শিশুরা বিদ্যালয়ে যায় লেখাপড়া করার জন্য তখন এরা নিজেদের ক্ষুণিœবৃত্তির জন্য খাদ্য অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার পথশিশু রয়েছে। রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, অফিস চত্বর, পার্ক ও খোলা আকাশের নিচে তাদের বাস। বড় অসহায় তারা। ঠিকমতো খেতে পারে না, ঘুমুতে পারে না, ভালো কোনো পোশাক পরতে পারে না। পায় না ভালো আচরণ। এ শীতের মধ্যেও গায়ে কোনো গরম কাপড় নেই। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব। শিশুরা আল্লাহতায়ালার বিশেষ অনুগ্রহের দান। পথশিশুরা কারো না কারো সন্তান, ভাইবোন বা আত্মীয়স্বজন। বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ৮০ লাখ পথশিশু। এদের মাঝে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ১০ লাখেরও বেশি। বেশির ভাগই অপুষ্টি, যৌনরোগ ও মাদকের নেশায় আক্রান্ত। সর্বনাশা মাদকের বিষে আসক্ত হয়ে পড়েছে হাজার হাজার পথশিশু। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, পথশিশুদের ৮৫ ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবন করে। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকই দরিদ্র হওয়ায় নিজেদের সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয় না। সংসারে অভাব লেগেই থাকে। তাই এ সব পরিবারের শিশুরা ছোট থেকে বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ে। কেউ বিক্রি করে ফুল, কেউ করে কুলিগিরি, কেউ হয় হকার, কেউ চালায় রিকশা। কেউ কেউ অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে। এ ভাবেই আমাদের শিশুরা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয়।
একটি শিশু কখনো পথশিশু হয়ে জন্ম নেয় না। জন্মের সময় প্রতিটি শিশুই তার অধিকার নিয়ে জন্ম নেয়। আজ যে শিশু ভালোভাবে কথা বলতে শেখেনি তাকেও জীবিকার তাগিদে ভিক্ষা করতে হচ্ছে। তার কাছে জীবনের মানেই হলো ক্ষুধা নিবারণের জন্য পথে পথে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেঁচে থাকার লড়াই। এদের দুরবস্থার জন্য দায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। শিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবছর পালিত হয় শিশু দিবস। জাতিসংঘ এবং এর অঙ্গ সংগঠন ইউনিসেফ শিশু অধিকার ও তাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
ডাক্তারদের ভাষায়, একটি শিশু মোটামুটি ৭ বছরের মধ্যে যা শেখে পরবর্তী জীবনে এ শিক্ষা বিরাট প্রভাব ফেলে। তাই এ সময়ে পথশিশুরা যদি লাঞ্ছিত হয়, অপমানিত হয়, কুশিক্ষা গ্রহণ করে, ছিনতাই, ভিক্ষা, সমাজের বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে পরিচিত হয় তাহলে সেটা তাদের জন্য এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বিরাট হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। আমরা চাই না পথশিশুরা এ সব খারাপ জিনিসগুলোর সঙ্গে পরিচিত হোক।
পথশিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। পথশিশুদের প্রতি নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি করতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ না থাকলে মানুষের জীবন বিপথে পরিচালিত হয়। যে সব শিশুর নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাব রয়েছে তারা অন্যায়ের দিকে পা বাড়ায়। শিশুদের নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। করতে হবে পথশিশুদের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা। শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের ওপর জাতীয় সমৃদ্ধি নির্ভরশীল। পথশিশুদের উন্নয়নের ব্যাপারে শুধু সরকারি কার্যক্রম নয় সচেতনতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। পথশিশুদের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে তুলতে হবে, চিন্তা করতে হবে স্থায়ী সমাধানের। উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে তারা যেন আত্মনির্ভরশীল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে সে ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। আলোকিত বাংলাদেশ গড়তে অবশ্যই পথশিশুদের জন্য মৌলিক অধিকারের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব শিশুর রয়েছে সমান অধিকার। পথশিশুদের রক্ষা করা, তাদের উন্নয়নে কাজ করা মুসলমানদের ঈমানি দায়িত্ব। শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রিয় নবী (সা.) যেমন সদা সজাগ ও সচেতন ছিলেন তেমনি সে আদর্শ অনুসরণে আমাদেরও আন্তরিক হতে হবে। শিশুটি যদি হয় এতিম, পথশিশু তবে তার লালনপালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করার দ্বারা জান্নাত লাভ করা সহজ হয়ে যায়। মেশকাত শরিফের একটি হাদিসে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘শুধু আল্লাহকে খুশি করার জন্য কোনো পিতৃহীন শিশুর মাথায় যদি কেউ হাত বোলায়, তবে তার হাত যত চুলের ওপর দিয়ে অতিক্রম করে, প্রতি চুলের পরিবর্তে তাকে অনেক নেকি দান করা হবে।’
আমরা চাই সুবিধাবঞ্চিত বা পথশিশু শব্দটি বিলুপ্ত হয়ে যাক। এ কোমলমতি শিশুদের আমরা কিছু দান করতে চাই। হতে পারে শিক্ষার আলো, নির্দিষ্ট বাসস্থান, কিংবা সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা। শিশুদের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ভার রাষ্ট্রের ওপরই বেশি বর্তায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ করতে হলে এ পথশিশুদের মূল্যায়ন অবশ্যই করতে হবে। তাদের দৈহিক ও মানসিক শক্তির সদ্ব্যবহার করার সুযোগ দিয়ে সমাজের মূলধারায় পুনর্বাসিত করতে হবে। রাষ্ট্রের উচিত পথশিশুদের সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন হওয়া। প্রতিটি পথশিশুর তালিকা করে এদের মৌলিক অধিকারগুলোর ব্যবস্থা করা। এ সব কাজ করা সরকারের একার পক্ষে করা সম্ভব হবে না, যে সংগঠনগুলো পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে রাষ্ট্রের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। রাষ্ট্রের পাশাপাশি শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগঠনগুলো যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করে এবং এ পথশিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাসহ মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে তাহলে এ পথশিশু বা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্য থেকেও আমরা পেতে পারি আগামীদিনের সুনাগরিক।
শিশুরাই একটি দেশের সম্পদ। প্রত্যেকটি শিশুর মাঝেই রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। পথশিশুদের পরিচর্যা করলে তারা বনলতা থেকে বটবৃক্ষে পরিণত হতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন কোনোভাবেই আমাদের দ্বারা অবহেলার শিকার না হয়। তারা যেন সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করতে পারে। হয়ে ওঠতে পারে ভবিষ্যতের সুনাগরিক।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন