বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জেরুজালেমের ইতিহাস

নূরুল হুদা হাবীব | প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০-৩৫০০ এর মাঝামাঝি সময়ে জেরুজালেমে সর্বপ্রথম বসতি স্থাপিত হয়। আরবি শব্দ সালাম এবং হিব্রæ শালিমের সম্মিলিত রূপ হিসেবে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এটির নামকরণ করা হয় ‘রুসালিমাম’। ১৫৫০-১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে তৎকালীন মিশরের রাজা জেরুজালেমকে মিশর সা¤্রাজ্যের একীভূত করে সা¤্রাজ্যকে ভূ-মধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। ক্রমান্বয়ে মিশরীয় শাসকদের ক্ষমতা লোপ পেতে থাকলে সা¤্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ থেকে স্বাধীনতার দাবী উত্থাপিত হয়। বাইবেলের বর্ণনামতে, জেরুজালেম তখন জেবুস এবং এর অধিবাসীগণ জেবুসিয়াস নামে পরিচিতি লাভ করে। বাইবেলের অপর এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, খ্রিস্টপূর্ব ১১শ শতকে রাজা দাউদের (দাউদ আ.) জেরুজালেম জয়ের পূর্বে শহরটি জেুবুসিয়াসদের বাসস্থান ছিল। পরবর্তীকালে তার পুত্র সুলাইমান আ. শহরের দেয়াল সম্প্রসারিত করেন। ৭ম শতকে অর্থাৎ ৬৩৭ সালে খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর শাসনামলে মুসলমানগণ জেরুজালেম জয় করে একে মুসলিম সা¤্রাজ্যের অঙ্গীভূত করে নেন। তিনি শহরের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রæতি প্রদান করে চুক্তিবদ্ধ হন।
আলেকজান্দ্রিয়ার পেট্রিয়ার্ক ইউটিকিয়াস বলেন, উমর চার্চ অব দ্য হলি সেপালচার পরিদর্শন করেন ও উঠোনে বসেন। নামাযের সময় হলে তিনি চার্চের বাইরে গিয়ে নামায আদায় করেন যাতে পরবর্তীতে কেউ তার নামাযের কারণকে ব্যবহার করে এই চার্চকে মসজিদে রূপান্তর না করে। ১০৯৯ সালে ১ম ক্রুসেডের সময় ইউরোপীয় খ্রিস্টান সেনাবাহিনী জেরুজালেম দখল করে এবং ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবী কর্তৃক বিজিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের আয়ত্ত¡াধীন ছিল। ১২১৯ সালে দামেস্কের সুলতান মুয়াজ্জিম নগরের দেয়াল ধ্বংস করেন। ১২৪৩ সালে মিশরের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী জেরুজালেম জার্মানির দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের হস্তগত হয়। ১২৩৯ সালে তিনি দেয়াল পুনর্নির্মাণ করেন কিন্তু কেরাকের আমীর সেগুলোকে ধ্বংস করে দেন। ১২৪৩ সালে জেরুজালেম পুনরায় খ্রিস্টানদের দখলে আসে এবং দেয়ালসমূহ সংস্কার করা হয়। কিন্তু ১২৪৪ সালে তাতাররা শহরটি দখল করে এবং সুলতান মালিক নগরপ্রাচীর ভেঙ্গে ফেলেন। ১৫১৭ সালে উসমানী খলিফা ইয়াভুজ সুলতান সেলিম কুদসকে উসমানী খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন।
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোরের ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিন উসমানী খিলাফতের হাতছাড়া হয়ে ব্রিটিশদের দখলে চলে যায় । সে বছর এমনই এক শীতার্ত ডিসেম্বরে ব্রিটিশ জেনারেল এডমন্ড অ্যালেনবি এসে পৌঁছান জেরুজালেমে। তবে ঘোড়ায় চড়ে বিজয়ী বীরের মতো জয়োল্লাস করতে করতে নয়, ঘোড়া থেকে নেমে পায়ে হেঁটে জেরুজালেমের জাফা গেট দিয়ে শহরে প্রবেশ করেন তিনি। এতদিন জেরুজালেম একটি পবিত্র ধর্মস্থান হলেও তা রাজধানীর স্বীকৃতি পায়নি। ব্রিটিশরা সেই স্বীকৃতি দেয়। আর তারই সঙ্গে শুরু হয়ে যায় নতুন সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট। যে সংঘর্ষের এক দিকে রয়েছে এই শহরের ভূমিপূত্র ফিলিস্তিনিরা। অন্য দিকে ইহুদিরা।
ইউরোপ জুড়ে ইহুদি বিদ্বেষের সূচনা হলে দলে দলে ইহুদি শরণার্থীরা ভিড় জমায় ফিলিস্তিনে, বিশেষ করে জেরুজালেমে। ১৫১৭ থেকে মুসলিম অটোমান শাসকদের অধীনে থাকা ফিলিস্তিনিদের কাছে অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি হয়। ঠিক তার উল্টো প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় ইহুদিদের মধ্যে। তাদের মধ্যে নিজেদের জন্য একটা আলাদা দেশ তৈরির আকাঙ্খা প্রবল হতে থাকে। কিন্তু এই আকাঙ্খার পিছনে তখন ধর্মের থেকেও জাতীয়তাবোধ ছিল প্রকট। রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা এই ইহুদিদের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের সংঘাতের ক্ষেত্র ক্রমেই প্রলম্বিত হয়। তৈরি হয় ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব জাতীয়তাবাদ। যার নেতৃত্বে ছিল নামকরা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলি। শুরু হয়ে যায় একের পর এক দাঙ্গা, রক্তপাত।
পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া যায় ১৯৩৯ সালে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে আসার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ব্রিটিশ প্রশাসন। এই নিষেধাজ্ঞার কারণেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অনেক ইহুদি আশ্রয়ের জন্য ফিলিস্তিনে আসতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। সমস্যা মেটাতে ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জাতিসংঘ। এক ভাগের অধিকার পাবে ইহুদিরা, অন্য ভাগে আরব ফিলিস্তিনীয়রা। আর জেরুজালেমের জন্য থাকবে বিশেষ মর্যাদা। সে কোনও ভাগের অংশ হবে না। আন্তর্জাতিক একটি কর্তৃপক্ষ এটি দেখভাল করবে। এ পরিকল্পনা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাল আরবরা। নিজেদের অধিকৃত অঞ্চলকে পরের দিন স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করে ইহুদিরা। তৈরি হয় ইসরাইল। জেরুজালেমের পশ্চিম অংশের দখল থাকল তাদের হাতে। পূর্ব অংশ, যার মধ্যে শহরের পুরনো অংশ, ফিলিস্তিনিদের হয়ে দখলে রাখে জর্ডান। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরছাড়া হয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সেনা প্রত্যাহার করা হলে সে বছরই ১৪ মে ডেভিড বেনগুরিনের নেতৃতে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইসরাইল পশ্চিম জেরুজালেম দখল করে। এরপরে বেশ কিছু দিন জেরুজালেমের অধিকারের জন্য দু’পক্ষ থেকেই তেমন দাবি ওঠেনি। জর্ডানের শাসক, রাজা প্রথম আবদুল্লাহ জেরুজালেম থেকে নিজেদের রাজধানী আম্মানকে ঢেলে সাজতে অনেক বেশি ব্যস্ত ছিলেন। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক চাপে ইসরাইলের শাসকরাও সেভাবে জেরুজালেমকে নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। বরং তেলআবিব, হাইফা, আসকালোন-এর মতো শহর উন্নয়নেই ব্যস্ত ছিল। ইসরাইলের প্রথম দু’দশকের শাসকদের মধ্যে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী নেতাদের সংখ্যা ও প্রভাব ছিল বেশি। এই নেতারা বুঝেছিলেন, জেরুজালেমের অধিকার পেলেও বা সেখানে রাজধানী বানালেও, কর্তৃত্ব বজায় রাখা বেশ শক্ত। আন্তর্জাতিক মহলও জেরুজালেম ভুলে, তেলআবিবে দূতাবাস খুলতে শুরু করে। তবে আরব-ইসরাইল বিবাদ চলতেই থাকে।
পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে ১৯৬৭ সালের জুনে। মিশরের তৎকালীন শাসক জামাল আব্দেল নাসের তাইরান প্রণালী দিয়ে ইসরাইলের জাহাজ যাতায়াত বন্ধ করে দেন। মিশর-ইসরাইল সীমান্তে সেনা সমাবেশ করেন। নাসেরের উদ্দেশ্য ছিল ভয় দেখানো। কিন্তু হঠাৎ পাল্টা বিমানহামলা চালিয়ে সব ওলট-পালোট করে দেয় ইসরাইল। সে হামলায় নাসেরের পুরো বিমানবাহিনী কার্যত ধ্বংস হয়ে যায়। পাশাপাশি গাজা ও সিনাই-এ স্থলযুদ্ধ শুরু করে ইসরাইল। এই অতর্কিত হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়ে মিশর। নাসেরের চেষ্টায় সিরিয়া ও জর্ডানও যুদ্ধ নামে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ছয় দিনের যুদ্ধ শেষে ইসরাইল মিশরের কাছ থেকে গাজা ও সিনাই, পশ্চিম তীর আর সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমির দখল নেয়। সে সময়ই তারা চূড়ান্তভাবে পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের আরব- যুদ্ধে ইসরাইল পাশাপাশি ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে ইসরাইল পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। প্রতিবাদে বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সংগঠন ওআইসি তাৎক্ষণিক জরুরি বৈঠক আহবান করে ১৩ ডিসেম্বর পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী ঘোষণা করে। ফলে জেরুজালেম এখন দুই রাষ্ট্র তথা মধ্যপ্রাচ্য সংকটের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এ সংকট ঘনীভূত হয়েছে আগ বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে। বিশ্বস¤্রদায়ের উচিত, এ মহাসংকটের আশু সমাধান করে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন