রোববার, ২৬ মে ২০২৪, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আরব বসন্ত, না বিভীষিকা?

কে. এস. সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

অতি মনমাতানো চিত্তাকর্ষণীয় শব্দ ‘আরব বসন্ত’। এটি আরব বিশ্বে দারুণভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ইদানীং আরব বসন্তের নাম তেমন আর শোনা যায় না। সম্ভবত মওসুমী বসন্তকালের মতো পরিবর্তনের আবর্তে বিলীন হয়ে গেছে। আরব বসন্তের বর্ষপূর্তি স্মরণ করে একে আরব ইতিহাসের স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে কিনা জানি না, তবে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি আরব বসন্তের সূচনা দিবস ছিল বলে বিবরণ দেখতে পাওয়া যায়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আরব বসন্ত নামে পরিচিতি পাওয়া গণ-আন্দোলনের ঝড়ের কারণে ২০১১ সালের পর থেকে ওই অঞ্চলের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আরব বসন্তের যে পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে, তা এই যে, পুলিশের দুর্নীতি ও দুর্বব্যবহারের প্রতিবাদে মোহাম্মদ বোয়াজিজি নামের এক তরুণের আত্মহুতির মধ্য দিয়ে ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ায় এ আন্দোলনের সূচনা হয়। পরে তা গণ অভ্যুত্থানের রূপ পায় এবং ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি দেশটির প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বেন আলির ২২ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পুলিশের দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে একজন দীর্ঘ মেয়াদী প্রেসিডেন্টের শাসনের অবসান ঘটানোর ঘটনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এতে সেদেশের জনগণের স্বাধীন মতামতের প্রতিফলন লক্ষ করার মতো, এটি তাদের পরম আনন্দের বিষয়ও বটে। এ বিজয়ের প্রভাব প্রতিক্রিয়া আশেপাশের বিভিন্ন মুসলিম দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। তিউনিসিয়ার পথ ধরে উত্তর আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়ে দীর্ঘ দিনের শাসকদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের দাবিতে গণ আন্দোলনের ঝড়, যাকে অভিহিত করা হয় ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে। এ বসন্ত বায়ুর ঝাপটা লাগে মিশর ও লিবিয়া হয়ে ইয়েমেনে। এসব দেশে দীর্ঘকালের স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের পতন ঘটে। আরব বসন্তের এ সুফল নজির বিহীন।
গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে অর্জিত সাফল্য যখন বসন্তের রূপ ধারণ করে, তখন তাকে স্থিত অবস্থায় রাখার বা তাকে আরো বেগবান করার উদ্যোগ প্রয়াসের অভাব নিশ্চয়ই ছিল না। কেননা অতীতের ঘটনাবলী আরবদের অজ্ঞাত ছিল না। অতীত বলতে যদি সীমিত অর্থে চলতি শতক হতে ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে এ শতকের প্রথম দশকে কেবল আরব বিশ্বের নানা স্থানে আরবদের মধ্যে প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন একেবারে হয়নি, তা বলা যাবে না। ঐ সময়ে মারাত্মক ভয়াবহ ঘটনাও ঘটেছে। উদারহণ স্বরূপ বলা যায়, ইরাকে সাদ্দাম শাসনের পতনের জন্য তুমুল আন্দোলন হয়েছে সে আন্দোলনকে সফল করার জন্য পরাশক্তিবর্গ তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে ইরাক ধ্বংস করেছে, লাখ লাখ লোক হত্যা করেছে এবং দীর্ঘকালের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছে, তার শাসনের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু সেই আন্দোলন বুশ-বেøয়ারের ইরাক বিরোধী জঘন্য ষড়যন্ত্র, আরব বসন্তকামীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য বলে অনেকেই মনে করে থাকেন।
গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম করার লক্ষ্যে আফ্রিকার মুসলিম দেশ তিউনিশিয়ায় যে আরব বসন্তের উদ্ভব হয় ২০১০-১১ সালে তার পেছনে পরাশক্তিবর্গের ইন্ধন ছিল কিনা তা তেমন বলা না হলেও তার ঢেউ যখন অন্যান্য আরব দেশেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না যে, মুসলিম বিদ্বেষী পরাশক্তিবর্গের তরফে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য সহযোগিতা এবং উস্কানিমূলক তৎপরতার মাধ্যমে বিভিন্ন মুসলিম দেশে পরস্পর ভ্রাতৃঘাতি সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়া হয়। ২০১১ সালের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির যে করুণ চিত্র ইউএন ইকোনমিক অ্যান্ড সোশাল কমিশন ফর ওয়েস্টার্ন এশিয়া কর্তৃক তুলে ধরা হয়েছে তাতে ৫ বছরে আরব বসন্তের ক্ষতি ৬১ হাজার কোটি ডলার উল্লেখ করা হয়েছে। বিবরণে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের পর থেকে ওই অঞ্চলের অর্থনীতির ৬১৪ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে যে, ক্ষতির এ পরিমাণ ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ওই এলাকার মোট দেশজ উৎপাদনের ৬ শতাংশ সূত্র দৈনিক ইনকিলাব ১২ নভেম্বর, ২০১৬। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যে তথাকথিত আরব বসন্তের জন্ম, আরব বিশ্বসহ প্রায় গোটা মধ্যপাচ্য এখনো তার আগ্রাসী থাবার শিকার। মিশর, লিবিয়া ও ইয়েমেনের কথা আগেই বলা হয়েছে। তথাকথিত আরব বসন্ত সিরিয়াকে যেভাবে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে তার বহুমুখী ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাব কখনো পাওয়ার নয়। সে দেশের নানা প্রকারে হত্যা, খুন, সম্পদ হানি, উদ্বাস্তু সমস্যা, বিতাড়ন এবং ভয়ংকরতম ধ্বংসলীলার বিবরণ দান করা সম্ভব নয়। সিরিয়ার মূল ভূখÐকে বিভিন্ন নামে ছিন্ন ভিন্ন করার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ন্যায় বুশ-বেøয়ার কর্তৃক ধ্বংস করা বিধ্বস্ত ইরাকে নতুন করে আরব বসন্তের রফতানির ফলে সেদেশকেও বহুখÐে বিভক্ত করার নেপথ্যে ষড়যন্ত্র সক্রিয় রয়েছে।
আবরবিশ্ব তথা মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আরবদের সার্বিক স্বার্থ রক্ষার একমাত্র বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন হিসেবে ‘জামেআতুল আরব’ বা আরবলীগের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয়। দ্বিতীয় মহা যুদ্ধের পর গঠিত ২২ সদস্য রাষ্ট্র সমন্বয়ের আরবলীগকে তখনকার দিনে আরব বসন্ত নামে আখ্যায়িত করার মতো সংগঠন ছিল। এ সংগঠন গঠিত হবার কয়েক বছরের মধ্যে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে পরাশক্তির গভীর ষড়যন্ত্রের বিষফল, মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া নামে খ্যাত তথাকথিত এবং অবৈধ ইসরাইলি রাষ্ট্র জন্ম লাভ করে। প্রথমে এ অবৈধ রাষ্ট্রকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানকারী রাষ্ট্র কোনটি সে কথা না বলেও এ ব্যাপারে আরবলীগের করণীয় ব্যাপারে প্রশ্ন করা যায়। ইসরাইলের ক্রম আগ্রাসন প্রতিহত করতে পরবর্তী সময়ে আরবলীগের কার্যকর ভূমিকা কী ছিল সে প্রশ্ন এখন অবান্তর বিবেচিত হতে পারে।
১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট ইসরাইল কর্তৃক মসজিদে আকসায় অগ্নিসংযোগের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে মরক্কোর রাজধানী রাবাতে অনুষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানদের সর্ববৃহৎ সংগঠন ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) এর আত্মপ্রকাশকে যদি বলা হয়, মুসলিম বসন্ত, তা অত্যুক্তি হবে না। আরবলীগ ও এ সংস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সমগ্র মুসলিম উম্মাভিত্তিক এবং আর বিশ্বভিত্তিক এ দুটি সংগঠন সংস্থার বর্তমানে ফিলিস্তিনসহ আরব রাষ্ট্রগুলোর কী অবস্থা, সে বিবরণ অল্প কথায় দেয়া সম্ভব নয়। মার্কিন সাহায্যপুষ্ট ইসরাইল ফিলিস্তিনকে প্রায় সম্পূর্ণ গ্রাস করতে বসেছে। মার্কিন যুক্তারাষ্ট্রের নতুন দাম্ভিক প্রেসিডেন্ট জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করে নতুনভাবে সমস্যা ও উত্তেজনা সৃষ্টি করেছেন এবং আরো নানাভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আরবলীগ ও এবং ওআইসি কেন নতুন বসন্তের জন্ম দিতে পারছে না? বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আরব বসন্তে আরবলীগ বা ওআইসিভুক্ত কোনো কোনো রাষ্ট্র তথাকথিত আরব বসন্তের কোকিল হয়ে ধ্বনি দিচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক পরাশক্তির খপ্পরে পড়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে। আরবলীগের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বর্তমান হাল পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট দেখা যাবে, আরব ঐক্যের মধ্যে যে বিরাট ফাটল ধরেছে তা সহজে পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবে একথাও স্বীকার করতে হবে যে, আরবলীগ একটি প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী সংগঠন হিসেবে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরাজমান অনেক বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে এখনো সক্রিয় ও কার্যকার ভূমিকা রাখতে সক্ষম বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্র সউদী আরব ও ইয়েমেন বিরোধ নতুন না হলেও পবিত্র খানা-ই কাবার দিকে ইয়েমেনের মিসাইল তাক করা নিন্দনীয় ঘটনা। আরব বিশ্বের নানাস্থানে আরো নানা প্রকারের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে চলছে এবং অকাট্য অভিযোগ রয়েছে এগুলোর অন্তরালে মুসলিমবিদ্বেষী শক্তি ও ইসরাইলের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। এসব বিষয়ে আরবলীগ নীরব থাকতে পারে না। আরব বসন্তের ¯েøাগানের রহস্য অনুভব করতে ভুল করলে আরো সর্বনাশের আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও আগে আরবলীগের জন্ম, অথচ বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি ২২টি দেশের এ জোট এখন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির আবেদন জানিয়েছে। এ দাবি বহু বছর আগেই জোরালোভাবে পেশ করার কথা। অনুরূপ আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যে ক্ষেত্রে আরবলীগের ভূমিকা দৃশ্যমান মনে হয় না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন