বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের চার বছর

প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৮:১২ পিএম, ১২ জানুয়ারি, ২০১৮

একটানা দুই মেয়াদের শেষ বছরে পা রেখেছে সরকার। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল এবং তার পরবর্তী পাঁচ বছরের মেয়াদের চতুর্থ বছর গতকাল শেষ করেছে। চলমান বছরটি সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ বছর। একটি সরকারের জন্য টানা ৯ বছর দেশ পরিচালনা করা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ শাসনামল নিয়ে সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয়টি বিশ্লেষণের দাবী রাখে। জনগণ কী পেল, কী পেল না এবং সরকার জনগণকে দেয়া তার প্রতিশ্রæতি বা নির্বাচনী ইশতেহার কতটা বাস্তবায়ন করতে পারল তার হিসাব জনগণ নিশ্চয়ই করবে। বিশেষ করে আগামী নির্বাচনের সময় যখন এক বছরেরও কম রয়েছে, তখন এ হিসাবটা জরুরি। সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে গতকাল প্রকাশিত প্রায় সবগুলো দৈনিকের প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতামতও তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৪ সালে ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শ্লোগান সামনে রেখে সরকার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চার বছর শেষে সরকারের সেই ইশতেহারের আশানুরূপ বাস্তবায়ন হয়নি। তাদের মতে, সরকার প্রতিশ্রæতির ৫০ থেকে ৬০ ভাগই বাস্তবায়ন করতে পারেনি। গণতন্ত্র ও সুশাসন শক্তিশালী না হওয়ায় ইশতেহারের বাস্তবায়ন ধীরগতিতে হচ্ছে। শেষ বছরে কিছু প্রতিশ্রæতি তড়িঘড়ি করে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে সরকার। পর্যবেক্ষ-বিশ্লেষকদের মতে, সরকার সংবিধান সুরক্ষা করলেও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে না পারা, গুম, অপহরণ, বিচারবর্হিভূত হত্যাকাÐ, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তারের মতো বিষয়গুলোর সুরাহা করতে পারেনি। অবশ্য শেষ চার বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে সরকারের প্রতিনিধিরা বলছেন, নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি অনেকাংশে বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি সব এ সরকারের মেয়াদেই হবে। বলা বাহুল্য, কোনো সরকারই তার ব্যর্থতা স্বীকার করতে চায় না। সে তার সাফল্যকেই বড় করে দেখায়। আখেরে সে কতটা সফল ও ব্যর্থ হয়েছে, তার প্রতিফলন ঘটে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ রায়ের মাধ্যমে।
এই দীর্ঘ সময়ে সরকার সার্বিকভাবে দেশ ও জনগণের কল্যাণ কতটা করতে পেরেছে, তা বিশ্লেষণের দাবী রাখে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকার বারবারই বিভিন্ন পরিসংখ্যান দিয়ে তার সাফল্যের কথা তুলে ধরেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাফল্য, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষা, নি¤œমধ্যবিত্ত দেশে পরিণত হওয়া, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ বিষয়ক তথ্য। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, পরিসংখ্যান দিয়ে সব খাতের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা গেলেও বাস্তব চিত্রের সাথে তার যথেষ্ট ফারাক থাকে। সরকার বলেছে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে। এ কথা সত্য বলে ধরে নিয়েও বলা যায়, যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে ব্যয়বৃদ্ধি এবং টানাপড়েনও সৃষ্টি হয়েছে। দ্রব্যমূল্যে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি মাথাপিছু আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। গত বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)-এর জরিপ অনুযায়ী, শহরের তুলনায় গ্রামে নিত্যপণ্যের দাম বেশি। মূল্যস্ফীতিও বেশি। গ্রামের মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের আয় কমে গেছে। গত বছর হাওরে অকাল বন্যা এবং উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় ফসলহানির পর তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি গোডাউনে খাদ্য মজুত সর্বকালের সর্বনি¤œ পর্যায়ে চলে যাওয়ায় সরকারকে লাখ লাখ টন চাল ও গম আমদানি করে সংকট সামাল দিতে হচ্ছে। চালের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ১৫-২০ টাকা। পেঁয়াজের দাম আকাশ ছোঁয়া। অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও নাগালের বাইরে। এখনও এই বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোনোভাবেই সহনীয় পর্যায়ে ছিল না। গুম, খুন, অপহরণ, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণ আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ গুম ও অপহরণের শিকার হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতো, সরকারের চার বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল বেপরোয়া। সরকারের দাবী মোতাবেক সাফল্যের সবচেয়ে বড় খাত বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা অতি উচ্চমূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। গ্যাস, পানির দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য কমানোর সুযোগ থাকলেও তা করা হয়নি। শিক্ষাখাতে প্রাথমিক থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের হিড়িক পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে দীর্ঘদিন ধরে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশের অপ্রতুলতায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ঋণাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। সুদের হার কমিয়েও বিনিয়োগকারীদের উৎসাহী করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরি থেকে শুরু করে সার্বিক ব্যাংকিং খাতে বেশুমার দুর্নীতি হয়েছে। পোশাক শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজারের বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। সার্বিক বেকারত্বের হারও বেড়েছে। বেকারত্বের হার নিয়ে সরকারের দেয়া পরিসংখ্যানের যর্থার্থতা নিয়ে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা দ্বিমত পোষণ করেছে। অবকাঠামো উন্নয়নের দিক থেকে পদ্মাসেতু নিয়ে সরকারের মধ্যে উচ্ছ¡াস সবচেয়ে বেশি। একটি স্প্যান বসিয়ে তা দৃশ্যমান করা হয়েছে। তবে চলতি বছর এর কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা শেষ হবে না। এছাড়া সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক দশটি বৃহৎ প্রকল্পের অধিকাংশের বাস্তবায়ন চলছে ধীরগতিতে। এসব প্রকল্পের জন্য মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ যথেষ্টই হয়েছে। এর অবসান ঘটাতে হবে। নির্বাচনের বছর হওয়ায় হয়তো দ্রæত গতিতে কিছু প্রকল্পের উদ্বোধন হতে পারে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নকেই উন্নয়নের ফায়দা হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তারা মনে করছেন, সরকারের প্রথম প্রতিশ্রæতি ছিল সুশাসন, গণতন্ত্রায়ণ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এগুলোতে সরকারের উল্লেখ করার মতো সাফল্য নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিরোধী মতের রাজনীতি সংকুচিত করা হয়েছে। গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী না হওয়ায় সরকার অনেক ক্ষেত্রে সফল হতে পারছে না। টেকসই উন্নয়নে পিছিয়ে যাচ্ছে। এ সরকারের আমলে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার ব্যাহত ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তবে কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ইসি সুষ্ঠুভাবে করতে পেরেছে।
যেহেতু বর্তমান সরকার তার দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ বছরে রয়েছে, তাই তার সাফল্য-ব্যর্থতার ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মানুষ বিচার করবে। আগামী নির্বাচনে যদি সরকার পুনরায় নির্বাচিত হতে পারে, তবে সরকারের গৃহীত উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। নির্বাচিত না হলে তার সাফল্য-ব্যর্থতা পরবর্তীতে আলোচিত হবে। এ বাস্তবতা মাথায় রেখে সরকারকে স্বপ্নবিলাসী হলে চলবে না, তাকে বাস্তববাদী হতে হবে। নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেয়ার চেয়ে চলমান যেসব উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে সেগুলো দ্রæত শেষ করতে হবে। এক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে এবং তা এ বছরের মধ্যেই। মনে রাখতে হবে, সরকার সকলের জন্য, তাই সকলের কল্যাণের জন্যই কাজ করতে হবে। সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য করতে সরকারকে আন্তরিকতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। আমরা আশা করব, সরকার চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অসম্পূর্ণ না রেখে দ্রæত গতিতে বাস্তবায়ন করবে। মেয়াদের শেষ বছরে সরকার সর্বতোভাবে সফল হোক, আমরা এ কামনাই করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন