পদ্মা-মেঘনায় এ সময় জাটকা ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ঢাকার বাজারগুলোতে জমজমাট জাটকা ব্যবসা চলছে বলে গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে। একদিকে সরকারী নিষেধাজ্ঞা অন্যদিকে খোদ রাজধানীতেই প্রকাশ্য অবাধে চলা জাটকা বেচাকেনা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এর মধ্য দিয়ে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে মৎস্য অধিদফতরের নেয়া উদ্যোগগুলো ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা তৈরী হয়েছে। নদ-নদীগুলো নাব্যতা হারানোর কারণে দেশে ইলিশের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমছিল। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ২০০৬ সাল থেকে ইলিশ ধরার প্রধান এলাকাগুলোতে, বিশেষত মেঘনা নদীর চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের ১০০ কিলোমিটার নৌপথকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করে বছরের ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দুই মাস শুধু জাটকাই নয়, সব ধরনের মাছ শিকার নিষিদ্ধ করা হয়। অন্যদিকে পরিণত ইলিশের উৎপাদন ও যোগান বাড়াতে নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত ৭ মাস ১০ ইঞ্চির ছোট ইলিশ বা জাটকা ধরা, বিপণন ও সংরক্ষণ দ-নীয় অপরাধ হিসেবে নিষিদ্ধ করে আইন পাস করা হয়। শুরু থেকেই এসব বিধি-নিষেধ যথাযথভাবে পালিত না হলেও এক সমীক্ষায় দেখা যায়, গত ১০ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞা আংশিক বাস্তবায়নে ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।
এক সময় আমাদের খাদ্যাভ্যাসের সাথে ‘মাছে ভাতে বাঙ্গালী’ বাগধারাটি চিরায়ত সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছিল। দেশের নদী, খাল ও হাওড়-বাঁওড়গুলো শুকিয়ে মাছের প্রাকৃতিক উৎসের বেশিরভাগ বিলীন হওয়া সত্ত্বেও এখনো মৎস্য চাষাবাদের মাধ্যমে এ দেশের জেলে-চাষীরা সফলতার সাথেই মৎস্যের চাহিদা পূরণে সক্ষম হচ্ছে। এখনো ইলিশ মাছ দেশের মোট মৎস্য চাহিদার শতকরা ১১ভাগ এবং অর্থনীতিতে মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) এক শতাংশ অবদান রাখছে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিগত দশকে গৃহিত পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশে ইলিশের হারানো ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে। ইলিশ সংরক্ষণবাদী নীতির কারণে এক দশকে ইলিশের বিচরণ দেশের ৫৭টি উপজেলা থেকে বর্তমানে শতাধিক উপজেলায় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা যায়। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৫ লাখ মানুষ ইলিশ ধরার সাথে যুক্ত রয়েছে, পরোক্ষভাবে ইলিশের অর্থনীতির সাথে জড়িত অন্তত ২০ লাখ মানুষ। সারাবিশ্বে ইলিশের উৎপাদন কমলেও বাংলাদেশে সরকারী উদ্যোগের কারণে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিক সাফল্য দেশের জন্য বড় ধরনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরী করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জাটকা রক্ষায় গৃহিত সরকারী পদক্ষেপের যে সব শিথিলতা ও ফাঁক-ফোকড় দেখা যাচ্ছে, তা’তে শেষ পর্যন্ত ইলিশের সোনালী সম্ভাবনা ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাও সমানভাবে দেখা যাচ্ছে।
নভেম্বরের প্রথম থেকে মে মাসের শেষদিন পর্যন্ত ১০ ইঞ্চির ছোট ইলিশ ধরা, বিপণন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ থাকলেও ঢাকার সব বাজারেই এ সময় প্রকাশ্য জাটকা ক্রয়-বিক্রয় হতে দেখা যায়। নিষিদ্ধ সময়ে কোস্টগার্ড এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। শত শত কেজি জাটকাসহ জেলে আটক, হাজার হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ ও ধ্বংস করার খবরও পাওয়া যায়। তবে ঢাকা শহরে অবাধেই চলছে জাটকার রমরমা ব্যবসা। ঢাকার পাইকারী মৎস্য আড়ৎগুলো থেকে প্রতিটি বাজারেই বিক্রি হচ্ছে দুই ইঞ্চি থেকে ১০ ইঞ্চি আকারের নিষিদ্ধ জাটকা। আর নিষিদ্ধ জাটকা ব্যবসার সাথে সরকারী দলের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে বলে জানা যায়। নদী থেকে জেলেদের কাছ থেকে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে কিনে আনা জাটকা ঢাকার পাইকারী বাজারে দেড়শ টাকা এবং খুচরা বাজারে আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জাটকা ধরা, বিপণন ও মজুদের জন্য দুই বছর পর্যন্ত কারাদ-ের বিধান থাকলেও প্রভাবশালীরা থানা-পুলিশকে ম্যানেজ করেই এই ব্যবসা চালাচ্ছে। একদিকে কোস্টগার্ডের অপর্যাপ্ত টহল ও নজরদারির কারণে ইলিশের অভয়াশ্রমে জাটকা নিধন বন্ধ হচ্ছে না, অন্যদিকে শহরে-বন্দরে সরকারী দলের নেতা এবং পুলিশের যোগসাজশে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারণে ইলিশ সংরক্ষণে সরকারী উদ্যোগগুলো ব্যর্থ হতে চলেছে। প্রতিদিন শত শত টন জাটকা ধরা এবং বিপণন বন্ধ হলে কয়েক লাখ টন পরিণত ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। জাটকা নিধন বন্ধে দিনে এবং রাতে কোস্টগার্ড ও নৌপুলিশের টহল বাড়ানোর পাশাপাশি জাটকা নিধন ও বিবণন সংক্রান্ত আইনের দৃষ্টান্তমূলক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। জাটকা নিধন বন্ধ রাখতে জেলেদের প্রণোদনা সহায়তা দেয়ার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তারও যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন