বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মহাসন স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস

প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আজ ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। স্বাধীনতার আজ ৪৫তম বর্ষ অতিক্রম করে ৪৬তম বর্ষে পদার্পণ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র দেশবাসীর ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে গণহত্যার এক নৃশংসতম অধ্যায়ের সূচনা করে। হানাদার বাহিনীর এই আক্রমণের মুখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। গড়ে তোলে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বাহিনী ও সেক্টর। ২৬ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে দেশবাসী উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তার এই ঘোষণা স্বাধীনতাকামী মানুষকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লাখ শহীদ, অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার আহত হওয়া এবং দুই লাখেরও বেশি নারীর সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যে কোনো জাতির পরম কাক্সিক্ষত বিষয়। আত্মপ্রতিষ্ঠার অধিকার, গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা, সুশাসন নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক মুক্তি, নিজস্ব সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে শুরু করে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই যে কোনো জাতির স্বাভাবিক চাওয়া। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এসব থেকে বঞ্চিত ছিল। তাদের মৌলিক অধিকার সে সময়ের শাসক গোষ্ঠী অস্বীকার করে আসছিল। শুধু অস্বীকারই নয়, মানুষের এই চাওয়াকে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য তারা বেছে নিয়েছিল ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার পথ।
আমাদের স্বাধীনতার মৌলিক তিনটি লক্ষ্য হলোÑসামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য। এর সাথে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছিল পরম আরাধ্য। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য যে, তাদের এসব চাওয়ার কোনোটিই যথাযথভাবে পূরণ হয়নি। কোনো কোনোটির কথা মুখে মুখে উচ্চারিত হলেও বাস্তবে দৃশ্যমান নয়। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ঠিকই, তবে স্বাধীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন সময়ে যারা শাসন করেছে, এই স্বাধীনতার মর্যাদা তারা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার পর একটি কথাই বারবার শুনেছে, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তারা কাজ করছে। যে দেশের মানুষ সুদীর্ঘকাল থেকে অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠীর নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছে, অকাতরে জীবন দিয়েছে, স্বাধীন হওয়ার পরও শাসক গোষ্ঠীর কাছ থেকে তাদের একই কথা শুনতে হচ্ছে। তাদের শুনতে হচ্ছে, এক শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক আরেক শাসক গোষ্ঠীর বদনাম ও পারস্পরিক দোষারোপের কথা। পারস্পরিক এই দোষারোপের রাজনীতির কারণে পুরো জাতি আজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। এখন সাধারণ মানুষ অবধারিতভাবেই জানে, তাদের কল্যাণের উছিলায় শাসক গোষ্ঠীর সুবিধার জন্য দ্বিধাবিভক্তির এ পথ সৃষ্টি করা হয়েছে। ইংরেজদের নিপীড়নমূলক ও সুবিধাবাদী নীতি ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ শাসক গোষ্ঠী অবলম্বন করে চলেছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ইংরেজ শাসনামল থেকে শুরু করে পাকিস্তানি শাসনামলের কবল থেকে বহু রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন হলেও তাদের অপনীতিই শাসক গোষ্ঠী অবলীলায় অনুসরণ করে চলেছে। এর ফলে মানুষের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বর্তমান শাসক দল একটি সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে এবং মানুষের সামনে এ বার্তা তুলে ধরছে, ‘আমার সাথে থাকলে তুমি বন্ধু, না থাকলে শত্রু।’ আমরা যদি রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সামাজিক ব্যবস্থার দিকে তাকাই, তাহলে এর স্পষ্ট মেরূকরণ দেখতে পাব। আরও দেখতে পাব, সংসদ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এক ধরনের এক দলীয় ব্যবস্থা কায়েমের প্রক্রিয়া। এ প্রবণতা যে আমাদের স্বাধীনতার মৌলিক উপাদানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। পর্যবেক্ষকদের মতে, দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদাবোধ ও সাম্যের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। মানুষের নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। গুম, খুন, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যর মারাত্মক অপরাধে জড়িয়ে পড়া, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় আশঙ্কাজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। সর্বত্র এক ধরনের অতিরিক্ত বল প্রয়োগের প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এমন এক সংস্কৃতির জন্ম দেয়া হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য, স্বাধীনতার পর থেকে দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটাই এগিয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। জিডিপি আশানুরূপ পর্যায়ে না গেলেও একটি নির্দিষ্ট অঙ্কে স্থির হয়ে আছে। দেশ নি¤œমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এসবই ইতিবাচক দিক। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, অর্থনৈতিক এসব সূচকের ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে শাসক গোষ্ঠীর অবদান না যতটুকু, তার চেয়ে বেশি সাধারণ মানুষের নিজস্ব উদ্যোগ ও কর্মক্ষমতা। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ দেখছে, তাদের শ্রমে-ঘামে গড়ে ওঠা অর্থনীতি থেকে বছরের পর বছর লাখ লাখ কোটি টাকা লুটেরা শ্রেণী লুটে নিচ্ছে। বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। এমনকি রাজকোষের অর্থও লোপাট হয়ে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে শাসক গোষ্ঠী কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। শাসক গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত বা প্রভাবশালী একটি শ্রেণী জনসাধারণের অর্থ লোপাট করে ফুলেফেঁপে উঠছে। মানুষের সাথে মানুষের আয়ের বৈষম্য আকাশ-পাতাল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাম্য ও মানবিক মর্যাদাবোধকে নি¤œগামী করে তোলা হয়েছে। বিরোধী মত দলন ও নিশ্চিহ্নকরণের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। মানুষের পক্ষে কথা বলার শক্তি সীমিত করে ফেলা হয়েছে। অন্যদিকে দেশ স্বাধীন হলেও বিশ্বের প্রভাবশালী সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মোড়লগিরি ও দাদাগিরির মাত্রা সীমাছাড়া হয়ে পড়েছে। শাসক গোষ্ঠী নিজ স্বার্থে একদেশদর্শী নীতি অবলম্বন করে চলেছে। ‘কারো সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব’ এ নীতির ব্যত্যয় ঘটতে দেখা যাচ্ছে। সার্বিকভাবে স্বাধীনতার ৪৫ বছরের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির দিকে তাকালে দেশের মানুষের দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না।
বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বলেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। তাদের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের জন্য জীবনবাজি রাখতে কুণ্ঠাবোধ করেনি তারা। বঙ্গবন্ধুর রচিত পথ অবলম্বন করে তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এসে যদি আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকানো যায়, তবে দেখা যাবে স্বাধীনতার তিন মূলমন্ত্র স্বাধীন দেশ শাসনকারী গোষ্ঠী বাস্তবায়নে সক্ষম হয়নি। ’৭১-এ একতাবদ্ধ জাতিকে একতাবদ্ধ রাখতে পারেনি। জাতিকে পুরোপুরি বিভক্তির পথে ঠেলে দিয়েছে। এ বিভক্তি যে দেশকে মারাত্মক সংকটের মুখোমুখি করবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে এ কথাও সত্য, বাংলাদেশের মানুষকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারলে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না, এর নজির এই স্বাধীন দেশেই তারা বারবার দেখিয়েছে। বিভিন্ন দুঃশাসনের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করে সঠিক পথে চলতে তাদের যূথবদ্ধ ঐক্য পথ দেখিয়েছে। এক ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে দেশের মানুষ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়, তা অতুলনীয়। দেশের স্বার্থে বাংলাদেশের মানুষ আপসহীন এবং কখনো ছাড় দেয় না। শাসক গোষ্ঠীকে মানুষের এই হৃৎস্পন্দন অনুভব করতে হবে এবং এ অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলেই স্বাধীনতার চেতনা যেমন ভূলুণ্ঠিত হবে, তেমনি ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাদের দাঁড়াতে হবে। আমরা আশা করব, যারাই দেশ পরিচালনা করুক না কেন, তারা সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, সাম্য-স্বাধীনতার এই মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে ব্রতী হবে। দেশে অবাধ গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করাসহ মানুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন