বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মেয়াদের শেষ বছরে এসে সরকারের গৃহিত সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ। মূলত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার আগে জুন- জুলাইয়ের মধ্যেই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো শেষ করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে উন্নয়ন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ের সচিব, ডিজি, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের কাছে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ চিঠি পাঠিয়েছে বলে গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে। আমরা জানি, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে তার সম্ভাব্যতা যাচাই, প্রাক্কলিত ব্যয় এবং সময়সীমা সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থার সাথে ঠিকাদার কোম্পানীর দরপত্রে চুক্তি আকারে সীমাবদ্ধ থাকে। এ ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্পের বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হলেই যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা হচ্ছে, ঠিকাদারী চুক্তি লঙ্ঘণ করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ণে অনাকাঙ্খিত দীর্ঘসুত্রিতা। বাস্তবায়নকারি সংস্থাগুলো নির্ধারিত সময়ে কাজ আদায় করে নিতে শুধু ব্যর্থই হয় না, মেয়াদের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে না পারা প্রকল্পের বার বার মেয়াদ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকল্প ব্যয়ও বাড়িয়ে থাকে। এহেন বাস্তবতা থেকে ধরে নেয়া যায়, প্রকল্প গ্রহণের আগে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা যে সব ফিজিবিলিটি রিপোর্ট জমা দিয়েছিল এবং দরপত্র দাখিলের সম ঠিকাদাররা মেয়াদের মধ্যে কাজের যে দর জমা দিয়েছিল তার কোনটিরই কোন সঠিক ভিত্তি ছিলনা। চুক্তি অনুসারে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থদের বিরুদ্ধে কখনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়না। উপরন্তু বার বার প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি করে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়।
সারাদেশে হাজার হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে আছে। দেশের প্রধান প্রধান মহাসড়কগুলোর চারলেনে উন্নীত করার মেগা প্রকল্প থেকে শুরু করে অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতির কারণে জনদুর্ভোগের চিত্র প্রায়শ গণমাধ্যমে উঠে আসছে। শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পেই নয়, শিক্ষা, ভ’মি জরিপ ও রেকর্ড প্রণয়ন ও সংরক্ষণে ডিজিটালাইজেশন, নিম্ন আদালতে বিচারব্যবস্থার সংস্কারের মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে বছরের পর বছর ধরে চলছে। অন্য একটি রিপোর্টে জানা যায়, জনদুর্ভোগ লাঘব করতেই বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্পসমুহ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরগুলোর ব্যর্থতা, দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, মানহীনতা ও লুটপাটের চিত্রও নতুন নয়। দেশি-বিদেশি উন্নয়ন বিশ্লেষক, দুর্নীতি পর্যবেক্ষণ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণসমুহ চিহ্নিত করে কাজের সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রনালয়, অধিদফতর ও স্থানীয় প্রশাসনের কাজের স্বচ্ছতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাজেট জায়েজ করা হয়েছে। গত বছরও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরীক্ষণ ও মূল্যায়ণ বিভাগের(আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে অন্তত ১০টি উন্নয়ন প্রকল্প কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে সম্পন্ন করার অভিযোগ করা হয়েছে। প্রকল্পগুলোতে বড় ধরনের দুর্নীতি- অনিয়ম হলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, প্রকল্প গ্রহণ করা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই ভুল ও বাস্তবতা বিবর্জিত সিদ্ধান্তের কারণে প্রকল্পের মূল লক্ষ্যই অনর্জিত থেকে গেছে এবং জনদুর্ভোগ বেড়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্টরা ঘাটতি বাজেট নিয়েও উন্নয়ন বাজেটের আকার বাড়িয়েই আত্মতুষ্টি ও রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরে লিপ্ত হয়েছেন। সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার চেয়ে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থে উন্নয়ন গৃহিত প্রকল্প গ্রহণের কারণে জনগেনর ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় অতি সাধারণ বাস্তবতা। এ অপচয় না হলে অনেক আগেই বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিনত হতে পারত। গত মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) সম্মেলনের উদ্বোধণী ভাষনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমৃদ্ধির পথযাত্রায় উন্নত দেশগুলোকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে বিডিএফ আলোচনায় দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন অংশিদারদের তরফ থেকে দুর্নীতি দমন ও সুশাসন নিশ্চিত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। জনগনের রাজস্ব এবং দেশি-বিদেশি ঋণের টাকায় বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না হলে উন্নয়ন বাজেট জনগনের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বদলে কতিপয় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি ও গোষ্ঠির সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যে সব উন্নয়ন প্রকল্প গত চার বছরেও বাস্তবায়ন করা যায়নি, মাত্র ৬ মাসে সে সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে কাজের মান এবং দুর্নীতি-অনিয়মের আশঙ্কা প্রবল। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় ও দফতরগুলো জনগুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পসমুহ বাস্তবায়ণে বিশেষ উদ্যোগ নিলে মন্দ হয়না। তবে তড়িঘড়ি প্রকল্প বাস্তবায়ণ করতে গিয়ে কাজের যথাযথ প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা ও কাজের মান রক্ষার শর্তগুলো যাতে লঙ্ঘিত না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন