দেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে গেলেও তা সক্ষমতার নিরিখে যথেষ্ট কিনা, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। অর্থনৈতিক অনেক সূচকেই উন্নতি হয়েছে। বাস্তবক্ষেত্রে তার প্রতিফলন সেভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বাজেট বেড়েছে, উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা বেড়েছে। সে তুলনায় উন্নয়ন এবং জনজীবনমানের উন্নতি হয়েছে বা হচ্ছে বলে দাবি করা যায় না। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু আয় নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ফাঁক-ফোকড় ও গোঁজামিল আছে। এর সুফলও মুষ্টিমেয় মানুষের ভোগাধিকারে। সাধারণ মানুষ এর বাইরে। সম্পদ কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত। তাদের সম্পদ শনৈ শনৈ বাড়লেও সাধারণ মানুষ বঞ্চিত ও নিরালম্বই রয়ে গেছে। আয়বৈষম্য যেভাবে বেড়েছে ও বাড়ছে তাতে ধনী আরো ধনী, গরীব আরো গরীব হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, তাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ন্যায়ভিত্তিক হলে, কাঙ্খিত মাত্রায় হলে এরকম হওয়ার কথা নয়। অন্যদিকে সরকার বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে দেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে বলে যে দাবি করছে তার যৌক্তিকতাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। অধিকাংশ বড় প্রকল্পই এখনো বাস্তবায়ন পর্যায়ে যেতে পারেনি। বিনিয়োগ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত হতে পারে না। অথচ সেই বিনিয়োগে বহু বছরেও গতি সঞ্চারিত হয়নি। কি দেশী, কি বিদেশী বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ অপরিহার্য। সেই পরিবেশ দেশ কতটা আছে তা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা অনেক। অবকাঠামো দুর্বলতা, দক্ষ জনবলের অভাব, ব্যবসা শুরুর পথে বাধা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, সুশাসনের অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, অবনত আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ইত্যাদির কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে।
গত শনিবার রাজধানীতে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সম্মেলন কক্ষে ‘বাংলাদেশ ডুয়িং বিজনেস’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এ প্রসঙ্গে অনেক কথা বলেছেন। তাদের সেসব কথা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রণিধানযোগ্য। কোনোরূপ রাখ ঢাক না করেই বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো: আমিনুল ইসলাম বলেছেন, দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন সক্ষমতার সমান নয়। সাত দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আমরা করেছি। এটা নিয়ে আমরা সুখী হতে পারি; আত্মতুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। যে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বয়স ২৫ বছরের নীচে, মুদ্রাস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে নীচে সেখানে আমরা কীভাবে বলি সক্ষমতা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি বা করছি। বিদ্যমান বাস্তবতায় বিনিয়োগ বাড়ার কথা; অথচ বাড়ছে না। তিনি সীমাবদ্ধতা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, দক্ষতার অভাবে প্রতি বছর বিদেশে চলে যাচ্ছে ৫ বিলিয়ন ডলার এবং ট্রেড লজিস্টিকের কারণে চলে যাচ্ছে আরো ৬ বিলিয়ন ডলার। উন্নয়নের জন্য আইন, প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামোর সামগ্রিক ব্যবস্থায় সংস্কার আনার ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। যথার্থই উল্লেখ করেছেন, ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখাতে হলে অর্থনীতির আকার এখনকার চেয়ে ১০-১২ গুণ বাড়াতে হবে। বলা বাহুল্য, সরকারের তরফে উন্নয়নের যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে দ্রুত অর্থনীতির আকার ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
অর্থনীতির আকার ও সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। ফলপ্রসু বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন করতে হবে। গোলটেবিল আলোচনায় বক্তরা প্রায় সবাই বলেছেন, আইন ও নীতি সংস্কার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলোর কাজের মধ্যে সমন্ব^য় সাধন ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে। এজন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাই যথেষ্ট। অন্যদিকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব বাধা রয়েছে তার দ্রুত অবসান ঘটাতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস-বিদ্যুৎ ইত্যাদির সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সুনীতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুতায়িত করতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই দরকার। এর অভাব রয়েছে। এক দশকেরও বেশী সময় ধরে দেশে রাজনৈতিক সংকট বিরাজ করছে। এ সংকট দূর করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্যও সরকারের সদিচ্ছা সবার আগে প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন