রাজধানীসহ সারাদেশে রাস্তায়-স্টেশনে বিক্রি হওয়া খাবারগুলোর মান নিয়ে সর্বদাই প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ এসব খাবার খাচ্ছেন। মুখরোচক হওয়ায় তাৎক্ষনিকভাবে এসব খাবারের মান নিয়ে ভোক্তারা তেমন মাথা না ঘামালেও প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের নানাবিধ অসুস্থতা ও স্বাস্থ্যসমস্যার সাথে জড়িত রয়েছে খাদ্যের পুষ্টিমান, পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো। একদিকে খাদ্য সামগ্রীতে ব্যবহৃত হচ্ছে নানাবিধ ভেজালসহ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রং ও রাসায়নিক উপাদান। অন্যদিকে খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুতে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা,নিরাপত্তাব্যবস্থায় ঘাটতির কারণে রোজকার খাদ্যসামগ্রিতে মিশ্রিত হচ্ছে ভয়ঙ্কর সব রোগ জীবাণু দেশের নদী নালা খালবিলের পানিতে মারাত্মক দূষণ ঘটেছে বহু আগেই। কোথাও কোথাও রান্না বান্না, ধোয়া মোছা ও পরিচ্ছন্নতার কাজে এসব উৎস থেকে সংগৃহিত পানিও ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকা শহর বা আশপাশের নদনদী ও জলাধারের পানি এতটাই দূষিত যে, খাবার প্রস্তুতে উন্মুক্ত জলাশয়ের পানি ব্যবহারের কথা চিন্তাও করা যায়না। সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক রিপোর্টে দেখা গেছে, ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি সরাসরি ব্যবহারযোগ্য নয়। আবার ঢাকা ও আশপাশে বিভিন্ন কোম্পানীর সরবরাহকৃত জার ও বোতলজাত কথিত নিরাপদ মিনারেল ওয়াটারের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগই দূষিত ও জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ঢাকা শহরে রাস্তায় বিক্রিত খাদ্য সামগ্রীতে মারাত্মক সব রোগজীবাণুর দূষণের তথ্য জানা যায়। জনস্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউট থেকে পরিচালিত গবেষনা সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকাসহ সারাদেশে রাস্তায় যে সব খাবার তৈরী ও বিক্রি হয় তার শতকরা ৯০ ভাগই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এসব খাবারে ই-কোলাই, সালমোনেলা, পুস্টমোল্ড, স্টেফালোকক্কাস, অ্যাপিডার্মিস জীবানুসহ নানা রকম ক্ষতিকর জীবাণু থাকে, যা খেলে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, আলসার, হৃদরোগসহ মারাত্মক সব প্রাণঘাতি রোগের সংক্রমণ ঘটে। শুধু রাস্তার খাবারেই নয়। শহরের নামিদামী হোটেল রেস্টুরেন্টের খাবারেও এসব জীবানু সংক্রমনের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়। খাদ্য সামগ্রী তৈরীতে দূষিত পানি, বার বার ব্যবহৃত ভোজ্য তেল এবং রাসায়নিক থেকে সংক্রমিত রোগ জীবাণুর ঝুঁকির পাশাপাশি রাস্তার পাশে বা উন্মুক্ত স্থানে তৈরী ও বিক্রিত খাদ্য সামগ্রিতে যান চলাচলের মাধ্যমে উড়ে আসা ধূলোবালি, দূষিত বাতাস, গাড়ীর কালো ধোঁয়া, অপরিচ্ছন্ন হাত ও পরিধেয় বস্ত্র থেকে জীবাণু সংক্রমন জনস্বাস্থ্যের জন্য খাদ্য সামগ্রীকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। বিশেষত: স্কুল পড়ুয়া শিশু, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথী, যানবাহনে কর্মরত শ্রমিকসহ সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ রাস্তায় তৈরী মুখরোচক খাবার খেয়ে সহজেই নানা ধরনের অসুস্থ্যতার ভুগে থাকে। ঝালমুড়ি, চটপটি-ফুসকা, বেলপুরি, নানা ধরনের পিঠা, মুড়কি, পেঁয়াজু, পুরি-সিঙ্গারা, পাপড় ভাজা, রুটি, ভাত-ডাল, মাছ-মাংস, খিচুড়িসহ শতাধিক প্রকারের খাবার বিক্রি হয় রাস্তায়।
সারাবিশ্বেই রাস্তার খাবারের জনপ্রিয়তা ও ঐতিহ্য দেখা যায়। স্ট্রীট ফুড নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রোগ্রামও প্রচারিত হতে দেখা যায়। তবে খাবার যেখানেই তৈরী বা বিক্রি হোক, তা হতে হয় পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিমান সম্পন্ন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তীক্ষè নজরদারির মধ্যে থাকতে হয়। স্বাস্থ্যের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর অবিক্রিত অবশিষ্ট খাবার ফেলে দিতে হয়। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কোন রকমের ঝুঁকি বা খামখেয়ালিপনা কোথাও বরদাসত করা হয়না। একমাত্র আমরাই যেন ব্যতিক্রম। শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে প্রতিটি খাদ্যপণ্যেই কোন না কোনভাবে ভেজাল, দূষণ ও নকলের সংশ্রব দেখা যায়। ঠিক একইভাবে বিশ্বের আর কোথাও স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষকে এভাবে হাসপাতালে ভীড় জমাতে দেখা যায়না। বাংলাদেশে কোটি মানুষ হেপাটাইটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনী সমস্যায় ভুগছে। এসব স্বাস্থ্য সমস্যার মূলে রয়েছে খাদ্যে ভেজাল, পরিবেশ দূষণ, খাদ্যমান, পুষ্টি ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে বেপরোয়া মনোভাব। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর রয়েছে, খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক দফতরও আছে তারা আদতে কি করছে সাধারণ মানুষ তা জানেনা। খাদ্য সামগ্রি তো বটেই, রোগ নিরাময়ের ওষুধ পথ্যেও দেদারছে ভেজাল, নকল ও মানহীন বাণিজ্য চলছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো যেমন তাদের দায়িত্ব পালন করছেনা। একইভাবে ভোক্তা অধিকার সংক্রান্ত ফোরাম এবং নাগরিক সমাজও এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে তেমন মাথা ঘামায়না। খাদ্য নিরাপত্তার মত বিষয়কে অগ্রাহ্য করে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। রাস্তায় খাদ্য সামগ্রী তৈরী ও বিপণন বন্ধ করা যাবেনা। তবে সরকারের বিশেষ নজরদারি ও খাদ্যদূষণের জন্য কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ফুটপাথ ও রেস্তোঁরায় খাবারের মান ঠিক রাখতে বাধ্য করা অসম্ভব নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন