মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ এক ॥
মুসলমানগণ বিভিন্ন বিজ্ঞান ও কলার বিকাশ ও উন্নয়নে যে অবদান রেখেছেন তার একটি সাধারণ বিবরণ এখানে তুলে ধরা হলো। প্রথমেই বলে রাখা আবশ্যক যে, ইসলাম কেবলমাত্র একটা ধর্ম নয়। স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে ইসলামের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং ইসলাম হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। সে কারণেই বিজ্ঞান ও শিল্পকলা চর্চায় ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোকপাত করা আবশ্যক।
দুনিয়াদারির জীবনকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করেনি, বরং সুস্থ সুন্দর জীবনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ বল, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে নিষিদ্ধ করেছে (৭ঃ৩২৭)? কুরআন মজীদে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে যারা বলে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের ইহকালে কল্যাণ দাও এবং পরকালেও কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে দোযখের আযাব হতে রক্ষা কর’ (২ঃ২০১)।
কুরআন মাজীদ শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহ যা তোমাকে দিয়েছেন তা দিয়ে আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান কর। দুনিয়া হতে তোমার অংশ ভুলিও না। পরোপকার কর যেমন- আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেও না আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালবাসেন না (২৮ঃ৭৭)। বস্তুতপক্ষে এমনি একটি সুন্দর জীবন লাভের প্রত্যাশায় মানুষ জগৎ সম্পর্কে জানতে চায়। বিশ্বচরাচরে বিরাজমান সমস্ত বিষয় সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভের আশায় সে সাধ্যমত প্রচেষ্টা চালায়। তার নিরলস প্রচেষ্টায় মূল উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত বিশ্বজগতের বিভিন্ন জিনিস থেকে উপকৃত হওয়া। দ্বিতীয়ত মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে যে, আমি তো তোমাদেরকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তাতে তোমাদের জীবিকার ব্যবস্থা করেছি (৭ঃ১০)। আরো ইরশাদ হয়েছেঃ তোমরা কি দেখ না আল্লাহ আকাশ ম-লী ও পৃথিবী যা কিছু আছে সব কিছু তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন। এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন (৩১ঃ২০)। কুরআন মজীদ একদিকে ইবাদত করার তাকীদ করে ইরশাদ হয়েছে ঃ তারা ইবাদত করুক ও গৃহের (অর্থাৎ কাবা শরীফের) রক্ষকের, যিনি তাদের ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভীতি হতে তাদেরকে নিরাপদ করেছেন (১০৬ঃ৩-৪), অপরদিকে কাজ করার তাকীদ দিয়ে নির্দেশ করা হয়েছে যে, আর এই যে মানুষ, তাই পায় যা সে করে (৫৩ঃ৩৯)।
কুরআন মজীদে শুধুমাত্র আবিষ্কারের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়নি, বরং নিত্য নতুন বিষয় উদ্ভাবনের উপরও যথাযথ জোর দেওয়া হয়েছে। যেমন- বলা হয়েছে যে, বল, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ তোমাদের পূর্ববর্তীগণের পরিণাম কি হয়েছে! তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক (৩০ঃ৪২)। আবার এ কথাও উল্লেখ আছে যে, যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং বলে হে আমাদের রব, তুমি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করনি... (৩ঃ১৯১)।
জ্ঞান অর্জনের পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কেও কুরআন মজীদে স্পষ্ট পথ-নির্দেশ রয়েছে। একটি অশিক্ষিত সমাজে নবী করীম (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর উপর প্রথম যে ওহী নাযিল হয় তাতেই পড়া ও লেখার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। সেখানে কলমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলা হয়েছে যে, কলম হল মানুষের জ্ঞান ভা-ারের নির্ভরযোগ্য হিফাজতকারী। বলা হয়েছে যে, পাঠ কর তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক হতে এবং তোমার রব মহা মহিমান্বিত, যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না (৯৬ঃ৫)। কুরআন মজীদ স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীগণকে জিজ্ঞাসা কর (১৬ঃ৪৩)। সেখানে আরো উল্লেখ আছে যে, তোমাদেরকে সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে (১৭ঃ৮৫); আমি যাকে ইচ্ছে মর্যাদায় উন্নীত করি। প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তির উপর আছে সর্বজ্ঞানী (১২ঃ৭৬)। প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি মোনাজাতের উল্লেখ করা যেতে পারে। মানবজাতিকে এই মোনাজাত সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে কুরআন মজীদ ঘোষণা দিয়েছে যে- বল, হে আমার রব, আমার জ্ঞানের বৃদ্ধি সাধন কর (২০ঃ১১৪)।
নবী করীম (সা.) বলেছেন যে, ‘ইসলামের ভিত্তি হল পাঁচটি ঃ এক আল্লাহর উপর পূর্ণ ঈমান আনা, সালাত কায়েম করা, রমজান মাসে রোজা রাখা, হজ্জ করা এবং যাকাত আদায় করা।’ বিশ্বাস বা ঈমানের সঙ্গে যদি তাত্ত্বিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংযোগ থাকে, তাহলে রোজা, সালাত, হজ্জ, যাকাতের সংযোগ রয়েছে পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে। যেমন- সালাত কায়েম করার জন্য একজন মুসলমানকে কিবলামুখী হতে হয় এবং সালাত কায়েম করতে হয় সুনির্দিষ্ট কতকগুলো প্রাকৃতি ঘটনা কখন ঘটে তার প্রেক্ষিতে। এ জন্য ভূগোল এবং জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হয়। আবার সঠিকভাবে সিয়াম সাধনার জন্যও প্রাকৃতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। যেমন- সূর্য উদয় বা অস্ত সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে সিয়াম পালন করা দুষ্কর। অনুরূপভাবে হজ্জ যাত্রীদেরকে মক্কায় যাওয়ার জন্য রাস্তাঘাট এবং যানবাহন প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান থাকাটা জরুরি। আবার যাকাত আদায় বা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পদ বিলি-বণ্টন করার জন্য অর্থ সম্পদ সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হয়।
কুরআনুল করীমে অনেক বৈজ্ঞানিক সূত্র এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। কুরআনকে জানা এবং বোঝার জন্য এ সমস্ত বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান থাকাটা অপরিহার্য। বস্তুতপক্ষে কুরআন অধ্যয়ন করতে হলে, যে ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে প্রথমে সে ভাষা জানতে হবে। এখানেই এসে যাচ্ছে ভাষা-বিজ্ঞান সম্পর্কে চর্চার প্রয়োজনীয়তা। এভাবেই ইসলাম আমাদেরকে ইতিহাস, ভূগোল এবং অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে চর্চার জন্য অনুপ্রাণিত করে। প্রসঙ্গক্রমে নবী করীম (সা.) মদীনায় এসে স্বাধীনভাবে বসতি স্থাপনের প্রারম্ভে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদের একটি অংশকে নির্ধারণ করে রাখেন বিদ্যালয়ের জন্য। দিনের বেলায় এ স্থানটি ব্যবহৃত হয় লেকচার হল হিসেবে। আবার রাতেল বেলা একটি ব্যবহৃত হত শিক্ষার্থীদের আবাসস্থল রূপে। স্থানটিকে বলা হত সুফফা।
কুরআনুল করীমে ইরশাদ হয়েছে : “হে মু’মিনগণ, যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন’ (৪৭ঃ৭, ২২ঃ৪০)। মুসলমানরা কুরআনের এ উপদেশবাণীকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেছিল। ফলে তাদের ভাগ্যও খুলে গিয়েছিল। সুতরাং এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, জ্ঞান চর্চা ও বিস্তারের জন্য মুসলমানরা সস্তা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে কাগজের ব্যবস্থা করেছিল। বস্তুপক্ষে হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী থেকেই বিশাল বিস্তীর্ণ মুসলিম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে কাগজের কল প্রতিষ্ঠিত হয়। উৎপাদিত হয় প্রচুর কাগজ। এখানে বিজ্ঞানের উন্নয়নে, বিশেষ করে মানবতার কল্যাণে মুসলমানগণ যে অমূল্য অবদান রেখেছেন তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলঃ-
ধর্ম বিষয়ক জ্ঞানের সূত্রপাত ঘটেছে কুরআনের মাধ্যমে। কুরআন মজীদ আল্লাহর কালাম। ওহীর মাধ্যমে এই কালাম মানুষের কাছে পৌঁছেছে। কুরআনকে জানতে ও বুঝতে হলে এর ভাষা, ব্যাকরণ এবং কুরআনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে হয়। কালক্রমে সমাজে এ বিষয়গুলোর প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায় এবং এর প্রত্যেকটি বিষয় এক একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যেমন- কুরআন পাঠ ও তিলাওয়াতের মধ্য দিয়েই উচ্চারণ রীতিরও বিকাশ ঘটে। পরবর্তীতে এটি একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞানের রূপ নেয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন