মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ দুই ॥
আবার কুরআনের বাণী সংরক্ষণের চেষ্টা চলে সেই শুরু থেকে। এর ফলে আরবী হস্তলিপি শিল্প উৎকর্ষ লাভ করে। দিনে দিনে হস্তলিপি খুবই নিখুঁত, পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উন্নততর বাক্য গঠন প্রণালী ও বিরতি চিহ্ন। এসব মিলিয়ে আরবী ভাষা খুবই সমৃদ্ধ হয়। দুনিয়ার অন্য কোন ভাষার সঙ্গে এর তুলনা হয় না। এভাবেই ভাষা বিজ্ঞানের উদ্ভব ঘটে।
ইসলামের একটি চিরন্তন বৈশিষ্ট্য এই যে, ইসলামকে বুঝতে হলে কুরআনকে বুঝতে হয়। আরব-অনারব সকলের জন্য একথা সত্য। সে কারণেই অন্যান্য ভাষায় কুরআনের তরজমা প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নবী করীম (সা.)-এর আমলে হযরত সালমান ফারসী (রা.) ফারসী ভাষায় কুরআন শরীফের অংশবিশেষ তরজমা করেন। তরজমা করার এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এখানে বলে রাখা আবশ্যক যে, যারা আরবী পড়তে পারে না, কুরআন বুঝে না, কেবলমাত্র তাদের বুঝার সুবিধার্থে কুরআনের তরজমা করা হয়। কিন্তু সালাত বা ইবাদত-বন্দেগীর সময় কোনভাবেই তরজমা ব্যবহার করা যায় না। তখন কেবলমাত্র কুরআনের মূল ভাষা ব্যবহার করতে হয়। এটা বাধ্যতামূলক।
কুরআনের আয়াতসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার জন্য নবী করীম (সা.) চমৎকার একটি পথ বাতলে দেন। আল্লাহ তা’আলার তরফ থেকে ওহী নাযিল হওয়ার সাথে সাথে সাহাবীগণ অতি যতেœর সঙ্গে তা লিখে রাখতেন। আবার কিছুসংখ্যক সাহাবী সঙ্গে সঙ্গে তা মুখস্থ করে ফেলতেন। ফলে আল্লাহর কালামের কোন বিবৃতি, বিচ্যুতি বা কোথাও কোন প্রকার ভুলত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কুরআনের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য আরো একটি পরীক্ষন ব্যবস্থা ছিল। তৎকালে বেশ কিছুসংখ্যক সাহাবায়ে কিরামকে কুরআন বিশারদ হিসাবে গণ্য করা হত। তারা হাতে লেখা কুরআন শরীফের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করে এর বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করতেন এবং এর যথার্থতা সম্পর্কে সনদ প্রদান করতেন। এখনকার দিনেও মুসলিম সমাজে এ নিয়মটি চালু রয়েছে। যারা কুরআন শরীফ হিফজ বা মুখস্থ করেন, তাদের বিশুদ্ধতা এভাবে যাচাই করা হয়।
মুসলমানদের নিকট কুরআন যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ নবী করীম (সা.)-এর হাদীসসমূহ। অতি যতেœর সঙ্গে তাঁরা নবী করীম (সা.)-এর কথা ও কর্মের বিবরণসমূহ সংরক্ষণ করেছেন। ব্যক্তিগত বা সমাজ জীবনের কোন কিছুই বাদ যায়নি। নবী করীম (সা.)-এর কিছুসংখ্যক ঘনিষ্ট সহচর তাঁর জীবদ্দশাতেই এই সংরক্ষণ প্রক্রিয়া শুরু করেন। তাঁর ইন্তেকালের পরও এই সংরক্ষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। সাহাবায়ের কিরাম ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ কাজটি শুরু করেন। তাঁরা হাদীসগুলো যেভাবে শুনেছেন, ঠিক সেভাবেই লিপিবদ্ধ করেছেন। অর্থাৎ প্রাইমারী সোর্সই ছিল হাদীস সংরক্ষণের মূল উৎস। সাহাবীগণ কারো নিকট কুরআনের আয়াত বর্ণনার সময় এর যথার্থতা অনুক্ষুণœ রাখার ব্যাপারে যেমন সতর্ক থাকতেন তেমনি সতর্ক থাকতেন হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে।
হযরত নূহ (আ.), হযরত মুসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.)সহ অন্যান্য আম্বিয়া কিরামের সম্পর্কে কিংবা বুদ্ধ সম্পর্কে আমরা খুব সামান্যই জানি। বিস্তারিতভাবে কেউ লিখতে চাইলেও পৃষ্ঠা কয়েকের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু নবী করীম (সা.)-এর জীবনী এত বিস্তারিতভাবে জানা আছে যে, শত শত পৃষ্ঠা লিখেও তা শেষ করা যায় না। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য তাঁর জীবনী যে কত যতেœর সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়েছে এ ঘটনা থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
নবী করীম (সা.)-এর জীবনকালেই মুসলমানগণের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে চিন্তার উন্মেষ ঘটে। পরবর্তীকালে এর উপর ভিত্তি করেই বিকশিত হয় বিভিন্ন বিজ্ঞানের। এর মধ্যে রয়েছে কালাম শাস্ত্র ও তাসাওউফ বিজ্ঞান। মুসলমানগণের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক প্রতিভাবান দার্শনিক জন্ম নেন। এদের মধ্যে ছিলেন আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, ইব্ন সিনা, ইব্ন রুশ্দ এবং আরো অনেকে। তাদের মৌলিক দর্শন ও পা-িত্যে ইল্ম, কালাম ও তাসাওউফ বিজ্ঞান আরো সমৃদ্ধ হয়। তাছাড়া গ্রীক ও সংস্কৃত বিষয় এই যে, গ্রীক ও সংস্কৃত শত শত পুস্তক আরবী ভাষায় অনূদিত হয়। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, গ্রীক ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত এ সমস্ত দর্শন গ্রন্থের বেশিরভাগই বিনষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু অনূদিত গ্রন্থসমূহ ভাবী বংশধরদের জন্য যতেœর সঙ্গে সংরক্ষিত আছে।
কুরআনুল করীম আল্লাহর কালাম। এর ভাষা আরবী। ইতিপূর্বে আরবী ভাষায় কোন পুস্তক ছিল না। পরবর্তীতে মাত্র দু’শ; বছরের মধ্যে অশিক্ষিত বেদুঈনদের এই ভাষাই বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত হয়। কালক্রমে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে আরবী আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা লাভ করে। এত অল্প সময়ের মধ্যে একটি ভাষা যে কিভাবে সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছল তা বিশ্লেষণ করে দেখা আবশ্যক। প্রথম যুগের মুসলমানদের বেশির ভাগই ছিলেন আরবীয়। অথচ ইসলামের প্রভাবে তারা তাদের স্বাতন্ত্র্যের কথা সম্পূর্ণরূপে ভুলে যান। অন্য ভাষা, বর্ণ ও গোত্রের মুসলমানগণকে পূর্ণ সমতায় গ্রহণ করার জন্য এটা দরকার ছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ভাষার ক্ষেত্রে। তারা আরবী ভাষাকে ভুলেননি। আর এটা এমন এক ভাষা যে ভাষায় কুরআন ও হাদীস সংরক্ষিত হয়েছে।
বস্তুতপক্ষে সকল গোত্র ও বর্ণের মুসলমানগণকে একই সমতায় গ্রহণ করার ফলে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। আরবী, ইরাকী, গ্রীক-তুর্কী, যারাই ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তাদের কেউ উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেননি। মুসলমানদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ছিল লক্ষ্য করার মতো। শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা খুবই নিখুঁত, নির্ভুল ও উৎকৃষ্ট মানের। ফলে খ্রিস্টান, ইয়াহুদী, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য জাতি তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। নিজেদের ধর্মজ্ঞান ও সাহিত্য দ্বারা মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমৃদ্ধ করে। এমনকি তাদের সহযোগিতা ও কর্মতৎপরতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখারও ব্যাপক প্রসার ঘটে। আরবী ছিল মুসলমানদের অফিসিয়াল ভাষা। আর এ সময় মুসলমানদের ব্যাপ্তি ছিল স্পেন থেকে সুদূর চীন পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চল জুড়ে। ফলে এ সময়ে অন্য যে কোন ভাষার চেয়ে আরবী ভাষার ব্যাপক বিস্তার ঘটে।
মুসলমানগণই সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইন সম্পর্কে ব্যাপক চর্চা শুরু করেন। প্রাচীনকালেও আইনের প্রচলন ছিল। ক্ষেত্র বিশেষে এগুলো বিন্যস্ত থাকলেও সেসব আইনের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। সে সময়ে আইনের দর্শন ও আইনের উৎস সম্পর্কে কোন আলোচনা হতো না। আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, প্রয়োগ-পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে কোন আলোচনা হতো না। আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, প্রয়োগ-পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা ছিল অনুপস্থিত। এমনকি ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এ বিষয়গুলো আইন বিশারদদের বিন্দুমাত্র নাড়া দিত না। মুসলমানগণ আইনের উৎস কুরআন ও হাদীসের আলোকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইন সম্পর্কে ব্যাপক চর্চা শুরু করেন। তারাই সর্বপ্রথম আইনকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের পূর্বে আর কেউ আইনের মতো এত বস্তুনিষ্ঠ, এত বিমূর্ত বিষয় নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেননি। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী থেকেই এর চর্চা শুরু হয়। তখন আইনকে বলা হত উসূলে ফিক্হ।
প্রাচীনকালে আন্তর্জাতিক আইন বলতে যা বুঝান হতো তাতে কোন আন্তর্জাতিকতা ছিল না। বস্তুতপক্ষে তাকে আইনও বলা যায় না। আসলে সেটা ছিল রাজনীতিরই একটা অংশ। এটা রাষ্ট্রনায়কদের ইচ্ছা এবং দয়ার উপর নির্ভর করত। তাছাড়া আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাপ্তিও ছিল সীমিত। যে সমস্ত রাষ্ট্রে একই ধর্ম বা ভাষাভাষীর লোকেরা বসবাস করত, কেবলমাত্র সে সমস্ত দেশের মধ্যেই এ আইন কার্যকর ছিল। মুসলমানগণ সর্বপ্রথম আইনকে একটি নির্দিষ্ট বিধি ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসেন, এর সঙ্গে জুড়ে দেন দায়িত্ব ও অধিকারের বিষয়টি। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, ইসলামের ইতিহাসের শুরুতে যে সমস্ত চুক্তিপত্র বা আইন প্রণীত হয়েছে, সেগুলোতেও আন্তর্জাতিক ধারাসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন