সাড়ে চার দশকের মধ্যে পদ্মায় পানি প্রবাহ এবার সবচেয়ে কম। গত ৭ ও ৮ মার্চ পদ্মায় পানির উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ৬৪ মিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে, ১৯৭২ সালের পর পানির উচ্চতা কখনোই এত নিচে নামেনি। এককালের প্রমত্তা পদ্মা এখন কার্যত একটি মরা গাঙ। রাজশাহীর গোদাগাড়ি থেকে কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর মুখ পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকার অধিকাংশই শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোথাও পানি নেই বললেই চলে। পদ্মার বুকজুড়ে জেগে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় চর। পানি না থাকায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১৫টি পিলারের মধ্যে ১২টিই দাঁড়িয়ে আছে শুকনো চরেÑনদীর অনেক বাইরে। বাকী তিনটি পিলার সামান্য পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে আশপাশের কৃষকরা চাষাবাদ করছে। পদ্মার মতো তিস্তায়ও পানি নেই। তিস্তার প্রবাহ কমে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকায় চর জেগে উঠেছে। একথা কারো অজানা নেই, পদ্মা ও তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল বহু শাখা নদী রয়েছে। মূল নদীতে পানি না থাকায় এসব নদীও শুকিয়ে গেছে। এও সবারই জানা, পদ্মা ও তিস্তার পানির উপর নির্ভর করে গড়ে তোলা হয়েছে দেশের দুই বৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা সেচ প্রকল্প ও গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প। এই দুই সেচ প্রকল্প এখন প্রায় অকার্যকর। গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের অধীন হাজার হাজার হেক্টর জমি পানির অভাবে সেচের বাইরে চলে গেছে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের অধীনে একদা ৭০/৭৫ হাজার হেক্টরে সেচ সুবিধা দেয়া সম্ভব হলেও এবার কয়েক হাজার হেক্টরে সে সুবিধা দেয়া সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ। গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প ও তিস্তা সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে যে বৈপ্লবিক সাফল্য এসেছিল এখন তা স্মৃতিÑইতিহাসে পরিণত হয়েছে।
পদ্মা-তিস্তা শুকিয়ে যাওয়ার কারণে এদের শাখা নদীগুলো মরণদশায় পতিত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে বহু নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া এসব নদীর বুকে এখন নানা ফসলের আবাদ হচ্ছে। নদীগুলো এক সময় সেচের আধার ছিল। এখন পানি কমে যাওয়ায় বা শুকিয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে চাষাবাদ করা হচ্ছে। এর ফলে প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে এবং পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক আগেই বিপদসীমার নিচে চলে গেছে। এরপরও নির্বিচারে পানি উত্তোলন অব্যাহত থাকায় অনেক ক্ষেত্রে গভীর নলকূপেও পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। এতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, উৎপাদনে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। আরো একটি মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় এই যে, ভূগর্ভস্থ পানির সাথে আর্সেনিক বিষসহ এমন কিছু ক্ষতিকর উপাদান উঠে আসছে যা ফসল ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। ওয়াকিবহাল মহলের জানা, শুধু কৃষির জন্য নয়, শিল্প ও পানের জন্যও বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন। প্রাকৃতিক উৎসগুলো পানি শূন্য হয়ে পড়ায় সব ক্ষেত্রেই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। ফলে কৃষির জন্য যেমন তেমনি শিল্প ও পানের জন্য পানির সংকট বাড়ছে এবং অবিশুদ্ধ ও ক্ষতিকর উপাদান সম্বলিত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে সব ক্ষেত্রেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা আগামীতে আরও বাড়বে। সে ক্ষেত্রে ক্ষতির মাত্রাও বাড়বে। আরও একটি বড় ক্ষতির আশংকাও এই সাথে বাড়বে। এভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর শুকিয়ে গেলে ভূগর্ভে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে। ভূমি ধস বা ভূমিকম্পের মাধ্যমে সেই বিপর্যয় আপতিত হতে পারে।
পানির দেশে পানির এই সংকট বা আকাল অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তব সত্য এবং এজন্য প্রধানত ভারতই দায়ী। বাংলাদেশ ও ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এমন নদীর সংখ্যা ৫৪টি। এই নদীগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিতে ভারত বাঁধ ও প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে উজান থেকে বেপরোয়াভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এতে বাংলাদেশ শুধু পানি বঞ্চিতই হচ্ছে না, উজান থেকে আসা পলি-বালি জমে নদীগুলোও দ্রুত ভরাট ও অনাব্য হয়ে পড়ছে। গঙ্গার পানি ভাগাভাগির জন্য যে চুক্তি হয়েছে সে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির কোনো হদিস নেই। অন্যান্য নদীর পানি বণ্টনেও কার্যকর কোনো আলোচনা ও উদ্যোগ নেই। ভারতের একতরফা পানি ছিনতাইয়ের কারণে যখন দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা, প্রকৃতি-পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং জনজীবনযাপনের ঐতিহ্য ভেঙে পড়ছে তখন সরকার একের পর এক বন্ধুত্বের ‘মাইলফলক’ স্থাপন করে যাচ্ছে। পানির ব্যাপারে তার কোনো উদ্বেগ-বিচলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ভারত যা চাইছে, অবলীলায় তা দিয়ে দিচ্ছে, বিনিময়ে কিছুই পাচ্ছে না। সরকার দেয়ার আনন্দে বিভোর, উদ্বেলিত। এই একতরফা সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব নানা দিক দিয়ে দেশকে যে বিপর্যয়ের প্রান্তসীমায় নিয়ে যাচ্ছে, সরকার তা খেয়ালই করছে না। এ অবস্থা কোনো বিবেচনাতেই কাম্য ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশ ও মানুষ বাঁচাতে সরকারকে অবশ্যই পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সক্রিয় ও তৎপর হতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সংস্থায় যাওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। সারা বছর নদীগুলো যাতে নাব্য রাখা যায় তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে নদী ড্রেজিংয়ের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এই সাথে ভূগর্ভের পানিশূন্যতা রোধে পানি উত্তোলন যেমন কমাতে হবে তেমনি বর্ষা মওসুমে ভূগর্ভে পানি সঞ্চালনের ব্যবস্থা নিতে হবে। বৈজ্ঞানিক-প্রাযুক্তিক প্রক্রিয়ায় ভূগর্ভে পানি ভরাট ও সংরক্ষণ করা সম্ভব। এদিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। যে কোনো মূল্যে পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন