বেশ কয়েকমাস ধরেই দেশে অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে ডলারের দাম। আন্তর্জাতিকভাবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গত কোন কারণ নেই। দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার কারণেই এভাবে ডলারের চাহিদা ও মূল্য বেড়ে চলেছে বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষককরা মনে করছেন। বিগত এক দশকে দেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকার বেশী বিদেশে পাচার হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক রিপোর্ট থেকে জানা যায়। প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নির্বাচনের বছরগুলোতে দেশ থেকে টাকা পাচারের হার অন্য সময় থেকে অনেক বেশী। চলতি বছরের শেষদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনার মধ্যে এ বছরেও টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে টাকা পাচারের প্রভাবই পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে ধরে নেয়া যায়। বিদেশে বিনিয়োগ, সেকেন্ড হোম ও আমদানী-রফতানী বাণিজ্য ও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়। ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচার করার ক্ষেত্রে মিথ্যা ইনভয়েসিংয়ের আশ্রয় নিয়ে থাকে সংশ্লিষ্টরা। খোলা বাজার থেকে বেশী মূল্যে ডলার কিনে চাহিদা পুরণ করা ছাড়াও ব্যাংকিং চ্যানেলগুলোও বেশী দামে ডলার বিক্রি করে কম রেটে রিপোর্ট দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাধারণত আমদানী ব্যয় বাড়লে রফতানী আয়ও বেড়ে থাকে। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানীর পেছনে ব্যয়িত অর্থের বড় অংশ রফতানীর মাধ্যমে দেশে ফিরে আসে। এটাই অর্থনীতির সাধারণ গতিপ্রকৃতি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমদানী ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলেও সে অনুপাতে রফতানী আয় বাড়ছেনা। আমদানী অনুপাতে রফতানী না বাড়ার পেছনে টাকা পাচারের কারসাজিকেই দায়ী করা যায়। আমদানী পণ্যে ওভার ইনভয়েসিং দেখিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচার করা হচ্ছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রির্জাভেও নেতিবাচক টান পড়েছে বলে জানা যায়। সেই সাথে বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়ে চলেছে। বৈদেশিক বাণিজ্য ডলারের মাধ্যমে হয়ে থাকে বলেই ঘাটতি বাণিজ্যের প্রভাব পড়ছে ডলারের বাজারে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি টাকা পাচারকারিদের জন্য তেমন কোন সমস্যা না হলেও দেশের বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে। এর ফলে আমদানী পণ্যের মুল্য বেড়ে যাচ্ছে এবং খুচরা বাজারেও পণ্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। ডলারের মূল্য ও চাহিদা বৃদ্ধির কারণে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাত্রী এবং কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ যাত্রীদের ডলার সংগ্রহ করতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। খোলা বাজারের ফড়িয়া বেপারীরা ডলার প্রতি তিন-চার টাকা পর্যন্ত বেশী মূল্যে ডলার বিক্রি করছে।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। বিনিয়োগে চরম মন্দার মধ্যেও বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে প্রাপ্ত রেমিটেন্স এবং গার্মেন্ট রফতানীর আয় থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মূদ্রা অর্থনৈতিক মন্দা প্রকট হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। গেøাবাল ফিনানসিয়াল ইন্টিগ্রিটি(জিএফআই) রিপোর্ট অনুসারে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ৬ লাখ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, আর এ সময়ে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে ৯৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বিনিয়োগের ৬গুনের বেশী টাকা বৈদেশিক মূদ্রায় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্ক নজরদারি থাকলে এত বিপুল পরিমান টাকা বিদেশে পাচার করা সম্ভব ছিলনা। এখন শোনা যাচ্ছে, পাচারকৃত ৬ লাখ কোটি টাকা ফেরাতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। নয় বছর ধরে টাকা পাচারের রাস্তা অবারিত রাখার পর নির্বাচনের বছর এসে সরকারের এ প্রয়াস কতটা সফল হবে তা সহজেই অনুমেয়। সরকারের সদিচ্ছা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলে অর্থ পাচার সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা এবং পাচার করা অর্থের বড় অংশ ফিরিয়ে আনা অসম্ভব নয়। তবে এ মুহুর্তের করণীয় হচ্ছে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণ সুচিহ্নিত করা। ডলারের বাজারের উপর নজরদারি বাড়ানো এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার পাচার রোধ করতে ইনভয়েসিং ও আমদানী-রফতানী বাণিজ্যের গতিবিধির উপর নজর রাখা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কি কারণে মানুষ বিদেশে পুঁজি সরিয়ে নিচ্ছে নিরপেক্ষভাবে তা খতিয়ে দেখতে হবে। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জননিরাপত্তা ও আইনের শাসন তথা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী না হলে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা পুনরুদ্ধার এবং পুঁজি পাচার রোধ করা অসম্ভব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন