আল জাজিরা : এখনকার দিনে ভারতে একটি জনপ্রিয় রসিকতা হচ্ছেঃ শাসক ভারতীয় জনতা দল (বিজেপি) মুসলমান নারীদের ভালোবাসে, মুসলমান পুরুষদের নয়। এ রসিকতার সৃষ্টি হয়েছে বিজেপির তার ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ইসলামের ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এক ক্রুসেডার হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টার কারণে। মোদি মুসলিম নারীদের এ সমাজ ব্যবস্থার খপ্পর থেকে মুক্ত করতে চান।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মুসলিম সমাজে প্রচলিত তিন তালাক নিষিদ্ধ করার পর গত বছরের আগস্টে বিজেপি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে শুরু করে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের চারমাস পর বিজেপি নিয়ন্ত্রিত লোকসভা এ প্রথাকে অপরাধ আখ্যায়িত করে একটি বিল পাস করে। এ বিলটি আইনে পরিণত হলে তিন তালাকের মাধ্যমে স্ত্রীদের পরিত্যাগকারী দোষী সাব্যস্ত মুসলিমদের তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
বিজেপির বিশ্বাস যে এ আইন মুসলিমদের এ কাজ করা থেকে বিরত করবে এবং মোদী মুসলিম পার্সোনাল ল’ সংস্কার ও সামাজিক আইনকে চ্যালেঞ্জ করার কৃতিত¦ পাবেন।
কিন্তু বহু মুসলিমই বিজেপির এ উদ্যোগের মধ্যে ভন্ডামি দেখতে পাচ্ছেন।
প্রথমত, এ বিলটি আসলে তালাক প্রথার বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে চলা মুসলিম নারী গ্রæপ ও ভুক্তভোগীদের আন্দোলনের ফল। উপরন্তু এ বিলের বিষয় বহু লোকের মনে এ বিশ^াস সৃষ্টি করেছে যে এটা আসলে মুসলিম নারীদের সাহায্য করার জন্য নয়, বরং মুসলিম পুরুষদের আরো অপরাধের ধরন বৃদ্ধি করা। এটা শুধু স্ত্রী নয়, যে কাউকেই অভিযোগ করার সুযোগ দেবে এবং সে ক্ষেত্রে স্বামী জেলে থাকলেও স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রধানমমন্ত্রী মোদি তার গোটা মেয়াদে হিন্দু নারীদের (এবং অন্য নারীদেরও) ক্ষতিগ্রস্ত করা সমাজ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে কিছুই করেননি। উদাহরণ স্বরূপ তার দল বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ গণ্য করার বিরোধিতা করেছে। বিজেপি নেতাদের মতে, ভারতের প্রেক্ষাপটে এটা সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
মোদি হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু অংশের মধ্যে ‘লাভ জিহাদ’ উন্মত্ততার মধ্যে টেনে আনা হিন্দু নারীদের সপক্ষে এখন পর্যন্ত কথা বলেননি।
লাভ জিহাদ
হিন্দু গ্রæপগুলোর অভিযোগ যে লাভ জিহাদ হচ্ছে হিন্দু মেয়েদের মুসলমানদের বিয়ে করতে প্রলুব্ধ করার মুসলমানদের একটি ষড়যন্ত্র যার একমাত্র লক্ষ্য মুসলমান করা। মাঝেমধ্যে আবার বলে, লাভ জিহাদের পিছনে রয়েছে উগ্রপন্থী মুসলিম গ্রæপগুলো।
গত বছরের ডিসেম্বরে নয়াদিল্লীর কাছে গাজিয়াবাদে এক মুসলিম যুবক ও এক হিন্দু নারীর বিবাহের প্রতিবাদে উগ্র হিন্দু কর্মীরা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তারা বলে যে এটা একট লাভ জিহাদের কাজ। এদিকে কনের পরিবার বলে যে বিবাহটি সম্মতি ক্রমেই হয়েছে। কিন্তু বিজেপি কর্মকর্তারা বলেন, পরিবারগুলো আন্তঃধর্মীয় বিয়ের কোনো অনুমতি পায়নি। এটা হচ্ছে বলপূর্বক ধর্মান্তরের ঘটনা। কনে বিয়ের আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি।
ভারতের সংবিধানে নাগরিকদের ধর্মান্তরের অনুমোদন রয়েছে। তাই দম্পতির কারো অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই। তারা বিশেষ বিবাহ আইনে বিবাহিত্। এ আইনে আন্তঃধর্মের মানুষ ধর্মান্তরিত না হয়েও বিয়ে করতে পারে। কিন্তু এ আইন আন্তঃধর্মীয় দম্পতিদের বিজেপির হিন্দু মৌলবাদীদের হামলা ও হয়রানি থেকে রক্ষা করতে পারছে না। তারা হিন্দু মেয়েদের সাথে সম্পর্ক থাকার জন্য মুসলমানদের উপর সহিংস হামলা চালাচ্ছে।
ডিসেম্বরে রাজস্থানের রাজাসামান্দে ৩৬ বছর বয়স্ক শম্ভুলাল রেগার আফরাজুল নামে ৫০ বছর বয়স্ক এক মুসলমানকে লাভ জিহাদের চেষ্টার অভিযোগে হত্যা করে এবং তার দেহ পুড়িয়ে দেয়। রেগার দাবি করে যে লাভ জিহাদ থেকে হিন্দু মেয়েদের রক্ষা করতে সে আফরাজুলকে হত্যা করেছে। পুলিশি তদন্তে দেখা যায়, রেগার অন্য মুসলমান যার সাথে এক হিন্দু নারীর প্রেম ছিল, তাকে সন্দেহে আফরাজুলকে হত্যা করেছে।
লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা দিন দিনই অধিকতর বর্বরতার রূপ গ্রহণ করছে। এ জানুয়ারিতে উত্তর প্রদেশের বাঘপতে একটি আদালতে তিন মুসলিম ভাইকে পেটানো হয় এ অপরাধে যে তাদের মধ্যে এক ভাই এক হিন্দু নারীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। হামলাকারীরা সবাই ছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) অঙ্গ সংগঠন বিশ^ হিন্দু পরষিদের লোক। আরএসএস বিজেপির জনক প্রতিষ্ঠান।
আরএসএস সমর্থিআরএসএস সমর্থিত হিন্দু মৌলবাদীদের মতে, হিন্দু নারীর জন্য কোনো মুসলমানের ভালোবাসা খাঁটি হতে পারে না। তা এক ভুয়া বিষয়। এটা আসলে একটি নিরীহ মেয়েকে ইসলামে দীক্ষিত করার, সন্ত্রাসী গ্রæপে টানার ও ভারতকে একটি মুসলিম দেশে পরিণত করার চেষ্টা।
এসব দাবি ও এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী মোদির নীরবতা ভারতে মুসলমানদের ব্যাপারে ভীতি সৃষ্টি করছে। এই ভীতি হিন্দু নারীদের ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি হত্যার কারণ হচ্ছে।
হিন্দু নারীদের টার্গেট করা
এ মাসের গোড়ার দিকে দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় কর্নাটক রাজ্যে একটি ছবিকে কেন্দ্র করে ধান্যশ্রী নামে ২০ বছর বয়স্কা এক তরুণীকে হিন্দু মৌলবাদীরা আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। হোয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইল ছবিটি বিকৃত করে শুধু একটি চোখ এমনভাবে রাখা হয় যেন সে ঘোমটা পরে আছে। বিজেপির যুব শাখা ভারতীয় জনতা যুব মোর্চা তার কাছে এ ছবিটি সরানোর দাবি জানায়।
মেয়েটিকে হয়রানি করা হয় ও গুজব ছড়ানো হয় যে সে এক মুসলিম তরুণের সাথে প্রেম করছে। এ অপমান সহ্য করতে না পেরে সে আত্মহত্যা করে।
বিজেপি কর্মকর্তারা ধান্যশ্রীর আত্মহত্যার বিচার না চেয়ে , যা তারা তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে করে, বরং তার আত্মহত্যার জন্য দায়ী লোকটির পক্ষ নিয়েছে।
চিকমাগলুর এক বিজেপি নেতা সি টি রাভি ভারতীয় মিডিয়াকে বলেন, ধান্যশ্রীর বেলায় যা ঘটেছে তা দুর্ভাগ্যজনক। অনিল নামে বিজেপির এক কর্মীকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু সে কোনো অপরাধ করেনি, সে কোনো হত্যা করেনি। সে মেয়েটির পরিবারকে লাভ জিহাদের বিপদ জানানোর চেষ্টা করেছিল যাতে এ পর্যন্ত বহু হিন্দু মেয়ে নিহত হয়েছে। ধান্যশ্রীর আত্মহত্যায় সে প্ররোচনা দেয়নি।
ধান্যশ্রী একাই শুধু ভারতে লাভ জিহাদ উন্মত্ততার শিকার নয়। সারা ভারতে মুসলিম পুরুষের সাথে প্রেমের কারণে বহু হিন্দু নারী নিগ্রহ ও হত্যার শিকার হচ্ছে।
কথিত আইএসআইএল সংযোগ
কেরালার এক হিন্দু তরুণী অখিলা দু’টি মুসলিম মেয়ের সাথে একটি ফ্ল্যাটে থাকত। গত বছর আগস্টে সে তার নাম পরিবর্তন করে হাদিয়া নাম গ্রহণ ও এক মুসলিমকে বিয়ে করে। ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দি লেভান্ট ( আইএসআইএল আবার আইএসআইএস নামেও পরিচিত) -এর সাথে যোগ দিতে সিরিয়া যাবার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে তার বাবা মামলা দায়ের করলে কেরালা হাইকোর্ট বিয়েকে বাতিল ঘোষণা করে।
হাইকোর্ট বলে, মেয়েটি দুর্বল ও অস্থির ছিল এবং তাকে প্রলুব্ধ করা হয় বলে সন্দেহ। বিয়ে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত¦পূর্ণ সিদ্ধান্ত, তা শুধু তার বাবা-মার সক্রিয় সম্পৃক্ততার ভিত্তিতেই নিতে পারে। হাইকোর্ট তাকে বাবা-মার সাথে গিয়ে বাস করার নির্দেশ দেয়।
হাদিয়ার স্বামী এ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। সুপ্রিম কোর্ট হাদিয়াসহ আন্তঃধর্ম বিবাহ তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় সন্ত্রাস দমন প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)-কে নির্দেশ প্রদান করে। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ হাদিয়াকে তলব করে এবং সে কি চায় তা জানতে চায়। হাদিয়া জবাব দেয়, আমি আমার স্বামীর সাথে যেতে চাই। কেউ আমাকে মুসলমান হতে বাধ্য করেনি।
হাদিয়া আশংকা প্রকাশ করে যে তার বাবা-মা তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে দেবে না। সুপ্রিম কোর্ট হাদিয়াকে কলেজে যাবার অনুমতি দিয়েছে। ২৩ জানুয়ারি তিন সদস্যের বেঞ্চ তাদের অবস্থান পুনঃনির্ধারণ করে বলে হাদিয়ার মস্তিষ্ক ধোলাই করা হলেও তাদের করার তেমন কিছু নেই। তারা বলেন, এটা তার স্বাধীন সিদ্ধান্ত হোক বা না হোক, সেই তা জানে। আমরা এতে নাক গলাতে পারি না। যদি সে আদালতে আসে ও বলে সে নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেছে, সেখানেই ব্যাপার শেষ।
যাহোক, এনআইএ লাভ জিহাদের অন্য সব দিক দেখা অব্যাহত রেখেছে এবং তারা কেরালার ৯০টি আন্তঃধর্র্মীয় মুসলিম বিবাহ তদন্ত করছে। ২০১৬ সাল থেকে কেরালা বিতর্কের মধ্যে রয়েছে। সে সময় সম্প্রতি ধর্মান্তরিত কিছু মুসলিমসহ ২১ ব্যক্তি আইএসআইএলে যোগ দিতে তাদের স্ব স্ব শহর ত্যাগ করে। হিন্দু ডানপন্থী গ্রæপগুলো তখন থেকে এ ঘটনাকে সকল আন্তঃধর্মীয় বিবাহকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তারা মুসলমানের সাথে প্রেমের সম্পর্ক থাকা হিন্দু নারীদের বেকায়দায় ফেলছে এ দাবি করে যে তারা প্রতারণার শিকার বা মস্তিষ্ক ধোলাই করা হয়েছে।
মহিলা অধিকার রক্ষা একটি মুখোশ
মুসলিম নারীদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে বিজেপি ও মোদির উদার মনোভাব মুসলিমদের ক্ষতে মলম লাগানো ছাড়া কিছু নয়। কয়েক দশক ধরে তাদের দুর্দশা তারা বাড়িয়ে চলেছে এবং তাদের নিজেদের স্বার্থে তার প্রচার করছে। ১৯৫০ দশকে ভারতে হিন্দু পার্সোনাল ল’ সংস্কার করে। কিন্তু মুসলিমদের ব্যাপারে কিছু করেনি।
হিন্দু গ্রæপগুলো দাবি করে যে মুসলিম ভোট পাওয়ার জন্য কংগ্রেস মুসলিম পার্সোনাল ল’ সংস্কার করতে অস্বীকার করে। এ বিষয়টি হিন্দুদের মনে বৈষম্যের শিকার হওয়ার মনোভাব সৃষ্টি করে যে দেশে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আজ বহু হিন্দুই মোদির তিন তালাকের জন্য শাস্তি বিধানের আইনকে সেই ঐতিহাসিক ভুল সংশোধন হিসেবে দেখছে।
প্রধানমন্ত্রী জানেন যে ভারতের মুসলমানরা অতীতে তাকে ভোট দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে বলে মনে হয় না। তাই তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের খুশি করতে ও তার ভিত্তি শক্ত করতে সব কিছু করছেন। মুসলিম নারীদের সম্মান প্রদর্শন বা তাদের অধিকারের জন্য তার কিছু করার নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন