আরিফ চৌধুরী শুভ : পৃথিবীর সফল ব্যক্তিদের সফলতার বেশির ভাগ ইতিহাস তার কঠোর পরিশ্রম আর ধৈর্য। এক এক জনের সফলতার ইতিহাস এক এক রকম। হাঁস, মুরগি ও কোয়েল পাখির ডিম ফুটানো মেশিন বানিয়ে সফল হয়েছেন বাপ্পী হাজারী ওরফে কোয়েল বাপ্পী। গড়েছেন ‘সাডেন লিংক ইনকিউবেটর কোম্পানি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। কোয়েল পাখি পালনের সখ থেকে কোয়েলের ডিম সংগ্রহ এবং ডিম ফুটানোর মেশিন বানিয়ে নিজে সফল হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছেন অনেকের। নিজেকে পরিবর্তনের চেষ্টায় সফল কোয়েল বাপ্পী’র সফলতার কাহিনীর পাশাপাশি যারা ঘরে বসে ইনকিউবেটর বানিয়ে সফল হতে চান তাদের জন্য পরামর্শ তুলে ধরেছেন আরিফ চৌধুরী শুভ।
ডাক নাম বাপ্পী হাজারী। ১৯৮১ সালে ফেনীতে জন্ম নেয়া এই যুবক কোয়েল বাপ্পী নামে বেশি পরিচিত। ছোটবেলায় কোয়েল পাখি পালনের সখে খুঁজে বেড়াতেন কোয়েলের বাচ্চা। সখ পূরণের জন্য ১৯৯৪ সালে ৮ম শ্রেণিতে পড়াকালিন টিফিনের টাকা জমিয়ে ১৫টি কোয়েলের বাচ্চা কেনেন। ধীরে ধীরে বাচ্চাগুলো বড় হয় এবং ডিম দেয়। তখন ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর চিন্তা আসে তার মাথায়। তুষ পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি কয়েকটি বাচ্চা ফুটান। বাড়তে থাকে আগ্রহ। পোল্টি খামারগুলোতে মেশিনে কিভাবে তাপ নিয়ন্ত্রণ করে ডিম ফুটায় তা দেখে নিজে কৌতুহলী হয়ে ওঠেন বাসায় মেশিন বানানোর চেষ্টায়। শুরু করেন কন্টোলার বানানোর গভেষনা। সফলও হন অবশেষে।
গল্পের শুরুটা ১৯৯৫-এর মাঝমাঝি সময়ে। ১৬ টাকা দিয়ে একটি মুড়ির টিন কিনে তার মধ্যে একটি বাল্ব ও ফ্যান বসিয়ে ডিম প্রতিস্থাপনের জন্য খাঁজ করেন। ২৮ দিন পর ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে। তবে কন্টোলার না থাকায় তখন তিনি টিনের নিচে পানির পাত্র রেখে তাপ নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
১৯৯৬ সালে পানি, বাতাস আর তাপ এক সাথে নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করে পাঁচ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি মেশিন বানান। এভাবে ১৯৯৮ সালে তৃতীয় বারের মত বড় আকারের ডিম ফুটানো মেশিন বানিয়ে তাক লাগিয়ে দেন বাপ্পী। ক্রমাগত সাফল্য দেখে ২০০১ সালে এইচএসসি পাশের পর ঢাকা ভাটারায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে কোয়েলের চাষে নেমে পড়েন। নিজের খামারে উৎপাদিত কোয়েলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬০০০। তবে ২০০৪ সালের বন্যায় অনেক কোয়েল মারা যাওয়ার পর আধুনিক ইনকিউবেটর ব্যবসায় মনস্থির করেন বাপ্পী।
প্রথম দিকে কোয়েল বিক্রি করে যে পরিচিতি পেয়েছেন খামারিদের কাছে পরবর্তীতে ইনকিউবেটর তৈরি করে তাদের কাছে হয়ে ওঠেন ইনকিউবেটর বাপ্পী হিসাবে।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩৯টি জেলায় বিভিন্ন খামারে তার বানানো প্রায় সাড়ে ৩ শত ডিম ফুটানোর মেশিন রয়েছে। শুধু তাই নয় সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার অনেক ল্যাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাপ্পীর তৈরি ইনকিউবেটর। তার তৈরি মেশিনগুলোর ধারণ ক্ষমতা ৩০ ডিম থেকে ৬০,০০০ পর্যন্ত। দাম ১০ হাজার থেকে ৫ লাখের মধ্যে। তবে বাপ্পী বলেন, বাহির থেকে কিনলে প্রতিটি মেশিনের দাম দ্বিগুণ গুনতে হবে ক্রেতাকে।
শুধু দেশে নয়, বিদেশেও যাচ্ছে সাডেন লিঙ্ক ইনকিউবেটর। নিজে ইনকিউবেটর বানানো শিখেননি, ১৫০ জনের অধিক মানুষকে কাজ শিখিয়ে চাকরি দিয়েছেন বিভিন্ন কারখানায়। তার কারখানায় নিয়মিত কাজ করছেন ১০-১৫ জন শ্রমিক। ভবিষ্যতে আর্ন্তজাতিক মানের ইনকিউবেটর বানানোর স্বপ্ন তার। নিজের কাজের স্বীকৃতির জন্য ২০১০ সালে কৃষি ও প্রযুক্তি মেলায় প্রথম স্থান অধিকার এবং ২০১৫ সালে পেয়েছেন গান্ধী পিস পুরস্কার।
কি কি লাগে ইনকিউবেটর তৈরিতে?
ঘরে বসে নিজে নিজে বানাতে পারেন ইনকিউবেটর বা ডিম ফুটানোর মেশিন। একটি ইনকিউবেটর বানাতে ধরকার পড়বে একটি কাঠের সাধারণ বাক্স, আধুনিক কর্কসীট, বা সীট দিয়ে মোড়ানো আধুনিক বক্স, ডিম বসানোর কেইচ, বাচ্চা ফুটানোর ট্রে, তাপযন্ত্র, আর্দ্রতাযন্ত্র¿, অটোমেটিক ইগ ট্রানিং, এবং ইলেকট্রিক লাইনের সুব্যবস্থা।
কোথায় পাবেন প্রয়োজনীয় জিনিস?
স্থানীয় বাজার থেকে জিনিসগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। ইলিকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতিগুলো লোকাল ইলিট্রিক্যাল দোকানে পাওয়া যাবে। প্রয়োজনে সহায়তা নিতে পারেন ‘সাডেন লিংক ইনকিউবেটর কোম্পানি’, এ্যাপোলো হাসপাতালের দক্ষিণ পাশে মাসুম হোটেলের দ্বিতীয় তলায়। বসুমতি সড়ক বসুন্ধরা, বারিধারা ঢাকা।
কিভাবে বানাবেন ইনকিউবেটর?
প্রথমে কাঠের তৈরি বক্সের মধ্যে কর্কসীটগুলো কাটার দিয়ে কেটে সুন্দর করে স্থাপন করতে হবে। তার পর ডিম বসানোর কেইসগুলো একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে বসিয়ে নিচে অটোমেটিক ইগ ট্রানিং খুব নিখুঁতভাবে বসাতে হবে। এর পরে বক্সের ভিতরে আলাদা খাঁজে তাপযন্ত্র সেট করে নিচে তাপনিয়ন্ত্রণ বা আর্দ্রতাযন্ত্র বসাতে হবে। সংযুক্ত করতে হবে নির্দিষ্ট ওয়াটের বাল্ব ও ফ্যান। এর পর ইলেকট্রিক্যাল সংযোগ দিলেই হয়ে যাবে ইনকিউবেটর। ভালোভাবে বানানোর জন্য একটি ট্রেনিং নিতে পারেন সাডেন লিংক ইনকিউবেটর কোম্পানিতে।
যা যা খেয়াল রাখতে হবে
ইনকিউবেটর তৈরির পর খেয়াল রাখতে হবে তাপমাত্রা সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা। আর্দ্রতাযন্ত্র সঠিকভাবে কাজ না করলে অতিরিক্ত তাপে ডিম নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা বেশি। অটোমেটিক ইগ ট্রানিং এ সমস্যা হলে দ্রুত ট্রে পরিবর্তন করতে হবে। প্রথম অবস্থায় কম ডিম বসিয়ে পরীক্ষা করে নিতে হবে আপনার বানানো ইনকিউবেটর সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন