লন্ডনের প্রভাবশালী ইকোনমিস্ট পত্রিকার সহযোগি ইকোনমিস্ট গ্রুপের গবেষনা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের(ইআইইউ) গণতন্ত্র সূচকে এবার বাংলাদেশের ৮ ধাপ অবনমন ঘটেছে। গত বছর যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৪তম, এবার সে অবস্থান থেকে ৯২তম অবস্থানে নেমে এসেছে। এই সূচক নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকে গত একদশকের মধ্যে গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশ এ বছর সবচেয়ে খারাপ স্কোর করেছে। এমন সময় ইআইইউ’র ডেমোক্রেসি সূচকের এই ফলাফল প্রকাশিত হল যখন বাংলাদেশে একটি চরম রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল চলছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১১ মাস বাকি থাকতেই সরকারীদল ও তাদের শরিকরা নির্বাচনী প্রচারনায় নেমে পড়েছে। অন্যদিকে গত নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা এখনো পুলিশি হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে কারাগারে কিংবা আদালত প্রাঙ্গণে ঘুরপাক খাচ্ছে অথবা যত্রতত্র ধরপাকড়ের শিকার হচ্ছে। এ অবস্থা অনেক আগে থেকেই চলছে। এখন আরেকটি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ ও অসহিষ্ণুতা সংযুক্ত হয়েছে যা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত ও অর্থনীতির জন্য একটি অশনি সংকেত। এ বিষয়টি ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ, বিশ্বসম্প্রদায় এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও ৫ জানুয়ারীর মত আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন প্রত্যাশা করেননা। কিন্তু বাহ্যিক প্রত্যাশা যাই হোক, দেশের সর্বসাম্প্রতিক রাজনীতিতে মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন বার্তা বহন করছে।
দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, উন্নয়ন সহযোগি ও পশ্চিমা দেশগুলোর আহ্বান উপেক্ষা করে এবং বেশীরভাগ রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত একপাক্ষিক নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতি একই সঙ্গে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। বিরোধিপক্ষের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা না করে কঠোর পুলিশি অবস্থানের মধ্য দিয়ে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি মোটামুটি সন্তোষজনক থাকলেও টেকসই উন্নয়নের মানদন্ডে অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশের কোন অগ্রগতি নেই বললেই চলে। এ সময়ে দেশ থেকে লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়েছে। গ্লোবাল ইকোনমিক ইনডেক্সের রির্পোটে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে যে পরিমানে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে দেশ থেকে বিদেশে টাকা হয়েছে তার ৬ গুণের বেশী। এ সময়ে দেশের অর্থনীতিতে যেমন স্থবিরতা দেখা দিয়েছে একইভাবে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও জননিরাপত্তায় মারাত্মক অবনতি ঘটেছে যা’ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশ আগের বছরের চেয়ে ৮ ধাপ নিচে নেমেছে বটে, এ অবস্থার উত্তরণে দেশের সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর কোন ইতিবাচক উদ্যোগ বা অবস্থান পরিলক্ষিত হয়নি। উপরন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে যতই দিন যাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কথিত দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষনার তারিখকে সামনে রেখে ব্যাপক পুলিশি ধরপাকড় শুরু হয়েছে।
এ সপ্তাহে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের ডেমোক্রেসী ইনডেক্স প্রকাশের পাশাপাশি ওয়াশিংটনভিত্তিক ননপ্রফিট সংস্থা ওর্য়াল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট(ডাবিøউজেপি) ২০১৭ সালের বৈশ্বিক ‘রুল অব ল ইনডেক্স’ প্রকাশ করেছে। সেখানে বিশ্বের ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১০২তম। যেখানে গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ, আইনের শাসন তিরোহিত, জননিরাপত্তা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে অবস্থান করছে সেখানে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন আশা করা বাতুলতা মাত্র। ইআইইউ ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থানের বর্ণনায় গত বছরগুলোতে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করা এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার উপর দমন নিপীড়মূলক অবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর রাজনৈতিক সরকারের অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশকে ‘হাইব্রিড রিজিম’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়। এহেন বাস্তবতা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদার জন্য সুখকর নয়। আইসিটি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার মামলায় সাংবাদিক, গণমাধ্যম কর্মী, ব্লগার, রাজনৈতিক কর্মীসহ শত শত মানুষকে হয়রানি-নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। গণমাধ্যম কর্মী, মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজের দাবীর মুখে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হলেও এখন নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আরো ভয়ঙ্কর হুমকিরূপে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই ধারা বাতিলের জন্য এখন গণমাধ্যম কর্মী ও নাগরিক সমাজ রাজপথে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার যে প্রত্যাশা সর্বমহল থেকে উচ্চারিত হয়েছে বাস্তব অবস্থা সম্পুর্ন বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বহু দল ও মতের শান্তিপূর্ন রাজনৈতিক সহাবস্থান অপরিহার্য। একটি বিপরীতমুখী ও সংঘাতপূর্ণ অবস্থা জিইয়ে রেখে এবং বিরোধি দল ও মতকে পুলিশের বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমনের কৌশল গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথ নয়। টেকসই উন্নয়ন ও আইনের শাসনের স্বার্থে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন