বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডবিøউইএফ) বিশ্বের তরুণদের নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। ১৮৬টি দেশের ৩১ হাজারের বেশি তরুণের মতামত নেয়া হয়েছে এই জরিপে। মহাদেশ ভিত্তিক এ জরিপে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রায় ১ হাজার ৩০০ তরুণের মতামত নেয়া হয়েছে। তরুণদের নিয়ে এ ধরনের জরিপ পরিচালনা করার উদ্দেশ্যগত তাৎপর্যপূর্ণ দিক এই যে, তরুণরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছে, নিজেদের দেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা নিয়েই বা তাদের মতামত কী সেটা নিরূপন করা, ধারণা লাভ করা। তরুণরাই আগামী দিনের দেশ ও বিশ্ব পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। সুতরাং তাদের দৃষ্টিভঙ্গী, চিন্তাভাবনা ও মতামত জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার শতকরা ৮২ ভাগ তরুণ জানায়, তারা নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায়। তারা মনে করে না যে, নিজেদের দেশে তাদের ভবিষ্যত আছে। তাদের এ মনোভাব বা মতামত নেতিবাচক হলেও কার্যকারণ বহির্ভূত নয়। তারা মনে করে, তাদের দেশে সবার জন্য সমান সুযোগ নেই। অসমতা বিদ্যমান যা তাদের বিকাশের জন্য, প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধান প্রতিবন্ধক। তাছাড়া তাদের মতে, তারা নির্ভয়ে জীবনযাপন করতে পারছে না, নিজেদের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, নিজেদের পছন্দের জায়গায় কাজ করতে পারছে না, এমন কি তাদের পক্ষে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাও সম্ভবপর হচ্ছে না। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের এই মতামতে বিদ্যমান বাস্তবতার অনিবার্য প্রতিক্রিয়াই প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশে এই বাস্তবতা তুলনামূলকভাবে অধিকতর প্রকট। গত বছর বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে একটি দৈনিকের তরফে এ ধরনেরই একটি জরিপ পরিচালিত হয়। ওই জরিপে শতকরা ৮২ ভাগ তরুণই জানায়, ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে তারা অনিশ্চয়তায় থাকে। আর সবার জন্য সুযোগের অভাবই এই অনিশ্চয়তার প্রধান কারণ। এছাড়া দুর্নীতি ও জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানায় ৫০ ভাগের বেশী তরুণ।
সুযোগের অভাব ও অসমতাই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের হতাশার প্রধান কারণ। ৪৭ শতাংশ তরুণ মনে করে, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুযোগের অসমতা রয়েছে। ৩৫ শতাংশ তরুণের মতে, দারিদ্র ও ৩৪ শতাংশ তরুণ শিক্ষার অভাবকে বড় সমস্যা মনে করে। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কোন তিনটি বিষয় তাদের ক্ষমতায়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? ৫৮ শতাংশ তরুণ জানায়, তাদের ক্ষমতায়নে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নতুন উদ্যাক্তা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগকে তরুণদের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ৫৪ শতাংশ তরুণ। আর ৪২ শতাংশ তরুণ মনে করে, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা তাদের ক্ষমতায়নে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জরিপে বিশ্বের তরুণদের একটি সাধারণ অভিমত উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, বিশ্বের তরুণদের ৫৬ শতাংশ মনে করে, রাষ্ট্রপরিচালক বা নীতি নির্ধার করা সিদ্ধান্ত নিতে তরুণদের বিষয়ে খুব একটা ভাবেন না। এর ফলাফল সম্পর্কে ডবিøউইএফ বলেছে, ৭৫০ কোটি জনসংখ্যার এই বিশ্বে অর্ধেকের বয়স ৩০ বছরের নীচে। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর চাওয়া নিয়ে নীতি-নির্ধারকরা গভীরভাবে ভাবেন না। তাদের চাওয়া-পাওয়া বিশ্ব পরিচালনায় উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। বলা আবশ্যক, তরুণদের চিন্তা-ভাবনায় আগের চেয়ে দ্রæত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এমন এক সময় ছিল, যখন শিক্ষিত তরুণদের একমাত্র কামনা ছিল একটি চাকরিনির্ভর পেশা। এখন এ জায়গা থেকে তরুণরা সরে আসতে শুরু করেছে। তারা এখন চাকরির বদলে নিজেরাই উদ্যোক্তা হতে চায়। তারা তাদের স্বপ্ন পূরণে চায় একটি উদ্যোক্তাসহায়ক পরিবেশ। এ সম্পর্কে জরিপে বলা হয়েছে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনানির্ভর বিভিন্ন উদ্যোগের বিকল্প নেই। তরুণরা কেবল নিজেদের সমস্যা, তার সমাধান বা চাওয়া-পাওয়া নিয়েই মতামত দেয়নি, একই সঙ্গে স্ব স্ব দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার দ্রæত সমাধান কামনা করেছে। এ ব্যাপারে সরকারের জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশা করেছে। বিশ্বের সমস্যা সম্পর্কেও তারা বেওয়াকিব নয়। তাদের মতে, বিশ্বের প্রধান তিনটি সমস্যা হলো, জলবায়ু পরিবর্তন, বড় আকারের যুদ্ধ এবং বৈষম্য।
বাংলাদেশ তারুণ্য নির্ভর একটি দেশ। এখানে কর্মক্ষম মানুষের অধিকাংশই তরুণ। এটা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট আশির্বাদ। বাংলাদেশের তরুণরা উদ্যমী, কর্মঠ এবং একই সঙ্গে সৃজনশীল ও আত্মপ্রত্যয়ী। কিন্তু সমস্যা হলো, তাদের উদ্যম, কর্মনিষ্ঠা, সৃজনশীলতা ও আত্মপ্রত্যয় ফলপ্রসূ করার সুযোগ এখানে অত্যন্ত সীমিত। সুযোগের অভাব ও অসমতা তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে দারিদ্র ও নানামুখী প্রতিবন্ধকতা। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশই বেকার, যার মধ্যে শিক্ষত বেকারের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। শিক্ষত হোক বা অশিক্ষিত প্রতিটি তরুণই কর্মসুবিধা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশাতেই তারা বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য এমন কোনো বৈধাবৈধ পথ নেই যা অনুসরণ করে না। এ জন্য তাদের অনেকে অকথ্য অত্যাচার-নির্যাতন ভোগ করে। অনেকে বেঘোরে প্রাণ পর্যন্ত হারায়। শিক্ষত তরুণরা উচ্চ শিক্ষার জন্য, উপযুক্ত কর্মপ্রাপ্তির জন্য বিদেশে চলে যেতেই বেশী পছন্দ করে। তারা আর ফিরে আসে না। ফিরে এলেও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পায় না। এখানে তরুণরা অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতার সমস্যারও ভয়াবহ শিকার। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিগত কয়েক বছরে এমন এক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যে, প্রতিদিনই মানুষ মরছে। কখনো আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে, কখনো সন্ত্রাসীদের হাতে। এদের অধিকাংশই তরুণ। কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব ও অসমতার পাশাপাশি নিরাপত্তার এই শোচনীয় অনুপস্থিতিতে তরুণরা হতাশ, সন্ত্রস্ত। অনেক ক্ষেত্রে এসব কারণে তাদের অনেকে বিপথগামীও হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা দেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ। অথচ এই তারুণ্যকে যদি যথাযথভাবে লালন করা যেতো, বিকাশের সুযোগ করে দেয়া যেতো তাহলে বাংলাদেশের চেহারা অনেক আগেই বদলে যেতো। সরকার ও নীতিনির্ধারকদের উচিত তরুণদের মুখ্য ভূমিকায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাতে তাদের স্বপ্ন পূরণ নির্বাধ ও অবারিত হয়। তরুণদের উপেক্ষা করে দেশের উন্নয়ন ও জাতীয় প্রতিষ্ঠার যত প্রত্যাশাই করা হোক না কেন, তা পূরণ হবে না। এটা কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, সকল দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন