শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

যানজট নিরসনে তৎপর হতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা : যানজট এখন রাজধানীর নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্রতিদিন নগরবাসীর ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা গিলে খাচ্ছে যানজট নামের ভয়ঙ্কর ভূত। জাতীয় অগ্রগতির জন্যও তা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানজট নিরসনে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও সুফল মিলছে না বাস্তবায়ন পর্যায়ের গাফিলতিতে।
রাজধানীর ৩৭টি পয়েন্টে ২৪ কারণে হামেশা লেগে থাকছে যানজট। দুঃসহ এ জটে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে রাজধানী। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সড়ক, মোড়, ট্রাফিক পয়েন্ট ও রেলক্রসিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা মানুষজন সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। যানজট নেই রাজধানীতে এমন সড়ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মালিবাগ রেলক্রসিং পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার সড়ক, শনিরআখড়া-যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার, গুলিস্তান-নবাবপুর-সদরঘাট পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার, শাহবাগ রূপসী বাংলা হোটেল মোড়-বাংলামোটর-সোনারগাঁও মোড় হয়ে ফার্মগেট পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার, নীলক্ষেত মোড়-নিউমার্কেট-কলাবাগান পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার, দক্ষিণ কমলাপুর-ধলপুর-সায়েদাবাদ ব্রিজ পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার, বনানী ক্রসিং-মহাখালী-নাবিস্কো বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার যানজটের দখলে থাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। ঢাকার ভয়াবহ যানজটের আরেকটি কারণ অভিজাত শ্রেণির দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ঘিরে অর্ধলক্ষাধিক প্রাইভেট গাড়ির আনাগোনা।
ঢাকায় রাস্তা বাড়ছে না। অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা নগরীতে এমনভাবে ভবন তৈরি হয়েছে, যেখানে রাস্তা বাড়ানোর সুযোগও কম। আন্তর্জাতিক মানদÐ অনুযায়ী ঢাকার রাস্তায় বড়জোর দুই লাখ ১৬ হাজার গাড়ি চলাচল করতে পারে। বাস্তবে চলছে তার চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বেশি। ফলে যানজটে নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে। তার পরও রাজধানীতে প্রতিদিন ৩৭১টি নতুন গাড়ি নামছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে গাড়ি নেমেছে এক লাখ ১৪ হাজার ২৭১টি, যার অধিকাংশই ব্যক্তিগত গাড়ি। ২০১০ সালে যেখানে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ছিল ছয় লাখের কম, ২০১৭ সালের অক্টোবরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ লাখে। আবার অ্যাপভিত্তিক গাড়ি চলাচল শুরু হওয়ায় গাড়িগুলোর ট্রিপ সংখ্যাও অনেক গুণে বেড়ে গেছে। অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ি সংগ্রহে আরো বেশি উৎসাহিত হচ্ছে। বাইরে থেকেও প্রতিদিন অনেক গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করছে। তাই অল্প কিছু উড়াল সড়ক বাড়লেও তা যানজট কমানোর ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি। অন্যদিকে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা হু হু করে বাড়লেও বাড়ছে না গণপরিবহন। পুরনো লক্কড়ঝক্কড় বাসেই চলছে বেশির ভাগ মানুষের অতি কষ্টের চলাচল।
শৃঙ্খলাহীনতাও রাজধানীতে যানজটের একটি বড় কারণ। বাস-মিনিবাসগুলো যেখানে-সেখানে দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করানো হয়। প্রাইভেট কার, ট্রাক, ভ্যান ইত্যাদি যত্রতত্র রাস্তার ওপরে পার্কিং করে রাখা হয়। একই সড়কে ধীরগতির ও দ্রæতগতির যানবাহন চলায় পুরো রাস্তায় গতি কমে যায়। অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজের জন্যও রাস্তায় যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়। ফুটপাতগুলো হকার ও দোকান মালিকদের দখলে চলে যাওয়ায় পথচারীরা বাধ্য হয় রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে। এতেও গাড়ি চলাচলের রাস্তা সংকুচিত হয়ে যায়। আর বিপজ্জনকভাবে রাস্তা পারাপার যানবাহনের গতি কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রচুর দুর্ঘটনাও ঘটায়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনার উল্লেখযোগ্য কোনো প্রচেষ্টাই দেখা যায় না। পুরনো ও ফিটনেসহীন গাড়িও যত্রতত্র নষ্ট হয়ে যানজটের সৃষ্টি করে।
বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নয়, ঢাকায় যানজটের দ্রæত বা আশু সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে জরুরি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। ঢাকায় প্রতিনিয়ত মানুষ বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে। এখনই উদ্যোগ না নিলে পাঁচ-দশ বছর পরে যে অবস্থা হবে, তাতে সমাধানের কথা চিন্তা করাও হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে। প্রয়োজনে নতুন ব্যক্তিগত গাড়ি নামানোকে নিরুৎসাহী করতে হবে। বিশেষ লেন করে গণপরিবহনের চলাচল সহজ করতে হবে। রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত যে ১২টি সড়কমোড়ে সরাসরি রাইট টার্ন ক্রসিং রয়েছে, সেগুলো ইউলুপে পরিণত করা হলে ২৫ ভাগ যানজট কমে যাবে। রাজধানীর যানজট নিয়ে মাসব্যাপী জরিপ শেষে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরাসরি রাইট ক্রসিংগুলো ইউলুপে পরিণত করা হলে এবং রেলক্রসিংসমূহে ছোট ছোট ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস করা হলে ঢাকার যানজট অর্ধেকে নেমে আসবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না থাকায় সিটি করপোরেশন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। বাড্ডায় ইউলুপ নির্মাণে যে দীর্ঘসূত্রতা চলছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। রাজধানীর দেড় কোটি মানুষকে যানজটের ছোবল থেকে বাঁচাতে হলে এ ব্যাপারে সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে।
লেখক: পরিচালক, এফবিসিসিআই, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন