আফতাব চৌধুরী : ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সপ্তদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক সৌধ তাজমহল পরিদর্শনে যান উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কট্টর বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথ। সেদিন তিনি তাজমহল ঘুরে দেখার জন্য আগ্রায় যান। ২৬ অক্টোবর সারাদিন ধরে ভারতীয় বিভিন্ন টিভির পর্দায় এই একই খবর পরিবেশিত হয়। এ খবর যখন দেখছিলাম, তখন আমার নিজের তাজমহল পরিদর্শনের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে তাজমহল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। দিল্লি থেকে সকাল ছ’টায় ট্যুরিস্ট বাসে করে রওয়ানা হয়ে দুপুর বারোটা নাগাদ আগ্রা ফোর্টে পৌঁছি। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বিকেল তিনটে নাগাদ তাজমহল পৌঁছি। সেখানে প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে সেই রাজকীয় সমাধির সৌন্দর্য উপভোগ করি। মোগল স¤্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগমের (যিনি মমতাজ নামে পরিচিত) স্মৃতির উদ্দেশে এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন। সৌধটি নির্মাণ শুরু হয় ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। প্রায় দুই দশক সময়ে ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে তার কাজ সম্পূর্ণ হয়। সৌধটির নকশা কে করেছিলেন এ প্রশ্নে বিতর্ক থাকলেও এ কথা সত্য যে, শিল্পনৈপুণ্যসম্পন্ন একদল নকশাকার ও কারিগর সৌধটি নির্মাণ করেন, যারা উস্তাদ আহমেদ লাহুরির সাথে ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান যখন ছিলেন মোগল স¤্রাট তখন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মমতাজ তাঁদের ১৪তম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে মমতাজ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে প্রচÐভাবে শোকাহত হয়ে পড়েন শাহজাহান। তারপর নিজে তার সমাধির ওপর প্রেমের একটা নিদর্শনস্বরূপ তিনি এই ঐতিহাসিক সৌধ নির্মাণ করেন।
যা হোক, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সেদিন শাহজাহান ও মমতাজ মহলে প্রায় আধাঘণ্টা সময় কাটান। তারপর যান শাহজাহান পার্কে। সৌধটির ভিতরে ও বাইরেও ঘুরে বেড়ান তিনি। তাজমহলের পশ্চিম গেটে ৫০০ বিজেপি কর্মীকে নিয়ে সাফাই অভিযানেও নামেন তিনি। সেখান থেকেই তিনি স্বচ্ছ ভারতের বার্তা দেন। তখন তাঁর মাথায় ছিল বেসবল হ্যাট, মুখে ছিল মাস্ক আর হাতে গøাভস। সেখান থেকেই তিনি ঘোষণা করেন, তাজমহল ও আগ্রার উন্নয়নের জন্য তাঁর সরকার ৩৭০ কোটি টাকা খরচ করবে।
আসলে সেদিনে তাঁর এই আচমকা তাজমহল পরিদর্শন ছিল ড্যামেজ কেন্ট্রালের একটা উদ্যোগ। কারণ, বিগত কয়েকদিন ধরে বিজেপি নেতারা তাজমহলের মতো ঐতিহাসিক সৌধ নিয়ে বিভিন্ন রকম মন্তব্য করেন। কিছুদিন আগেই উত্তর প্রদেশ সরকারের পর্যটন দপ্তরের বুকলেট থেকে তাজমহলকে বাদ দেওয়া হয়। এ-নিয়ে প্রচুর-তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। বিতর্কের অংশ হিসেবে বিজেপি বিধায়ক সঙ্গীত সোম বলেন, রাজ্যের পর্যটন পুস্তিকায় তাজমহলের নাম বাদ পড়ায় নাকি অনেকেই ভীষণ হতাশ। আমরা কোন ইতিহাসের কথা বলছি? তাজমহলের ¯্রস্টা (শাহজাহান) নিজের বাবাকেই বন্দি করেছিলেন। মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন হিন্দুদের অস্তিত্ব। এঁরাই যদি আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকেন, তাহলে তা খুবই দুঃখের। আমরা এই ইতিহাস বদলে দেব। সঙ্গীত সোমের ওই মন্তব্যের পরে অস্বস্তিতে পড়ে যোগী সরকার। আরেক বিজেপি নেতা বলেন, তাজমহল আসলে একটি শিবমন্দির। সঙ্গীত সোমের ওই মন্তব্যের পর অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমি (এআইএমআইএম)Ñএর প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘লালকেল্লাও তো মোগলরা বানিয়েছিল। তা হলে কি মোদিজি এবার থেকে লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন বা ভাষণ দেওয়া বন্ধ করে দেবেন?’
যোগী আদিত্যনাথের তাজমহল যাত্রা নিয়ে রাজনীতি কম হয়নি। কেউ বলেছেন, তাজমহলে গিয়ে কেন যোগীর সঙ্গীরা জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিলেন? কেউ বলেছেন, যোগীর বুঝি শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে! উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব যোগীকে কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘একটা সময় তাজকে ঐতিহ্য হিসেবে মানত না বিজেপি। এখন মুখ্যমন্ত্রী তাজমহলের পশ্চিম গেটে ঝাড়– দিচ্ছেন। এর সামনে তাঁর একটা ছবি দেখব, এই অপেক্ষায় আছি।’ কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত হলো, তাজমহল নিয়ে বিতর্ক মোটেও সমীচীন নয়। ভারতে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ হলো তাজমহল। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে আগ্রায় বিদেশি পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনা তাজমহলের মহিমাকে কিছুটা হলেও সংকুচিত করেছে। এই তো সেদিন আগ্রায় গুন্ডাদের হাতে হেনস্তার শিকার হয়েছেন দু’জন সুইস যুবক ও যুবতী। আক্রান্ত সুইস যুবক কুইনটিন জেরেমি ক্লার্ক বলেছেন, ‘আগ্রায় তাজমহল দেখে একদিন সেখানে কাটিয়ে ২২ অক্টোবর আমরা ফতেপুর সিক্রিতে যাই। ফতেপুর স্টেশনের কাছে আমাদের উদ্দেশে কিছু একটা বলে স্থানীয় কয়েকজন যুবক। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তারা আমাদের পিছু ধাওয়া করে। জোর করে তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমরা কিন্তু তাদের কথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তারপর আমার বান্ধবীর সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য পথ আটকায় তারা। আমরা দাঁড়াতে বাধ্য হই। সেলফি তোলার জন্য দাঁড় করিয়ে আচমকাই কিছু লোক আমাদের মারধর করতে থাকে। রেহাই পায়নি আমার বান্ধবীও। রাস্তায় ফেলে পাথর ও লাঠি দিয়ে আমাদের ওপর আঘাত হানা হয়। কিন্তু আমাদের এভাবে আক্রান্ত হতে দেখেও আশেপাশের কেউ এগিয়ে আসেননি। বরং তারা মোবাইলে ভিডিয়ো তুলছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, ভারতের মতো দেশ, যেখানে তারা অতিথিদের সম্মান করতে ভালোবাসে, সেই ভারতেই দুই বিদেশি পর্যটকের ওপর এরকম আঘাত? এতে কি ভারতের মাথা উঁচু হয়েছে?
আজ ভারতীয়রা তাজমহল বিতর্কে নিজেদের শামিল করে সঠিক উন্নয়নের কথা ভুলতে বসেছে। সেখানে আজ হিন্দু-মুসলমান বিতর্কে এতটাই মনোনিবেশ করা হচ্ছে যে, এতে করে সঠিক উন্নয়নের বিতর্ক একেবারে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এখন প্রয়োজন উন্নতমানের পথ-ঘাট, সঠিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষিত বেকারদের চাকুরি, নারীকুলের মর্যাদা, লেখক ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা। আর তা না-করে ভারতের বিজেপি সরকার উগ্র ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। আজ ভারতীয়দের এ-নিয়ে ভাবনা শুরু করে দিতে হবে। ধীরে ধীরে সে দেশ যেভাবে অন্ধকারের দিকে চলে যাচ্ছে, একে সেই অন্ধকার থেকে বের করে নিয়ে আসার দায়িত্ব কিন্তু ভারতবাসীরই। আর সরকার পক্ষের লোকদের এই ভাবনার পথ ধরে চলার জন্য বাধ্য করানোও তাদের কর্তব্য বটে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন