মুসলিম সমাজে আজান কেবল নামাজের জন্য আহŸানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এই ঐতিহ্য সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। বিশেষতঃ কোন মুসলিম পরিবারে সন্তান জন্মলাভ করলে নবজাতকের কানে আজান-একামত দেওয়া ছাড়াও অগ্নিকান্ডের সময়, ভূমিকম্প দেখা দিলে এবং বালা-মসিবত ও বিপদাপদের সময় আজান দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। কাজেই আজানের ধর্মীয় গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা বাদ দিলেও এর সামাজিক গুরুত্বও বিরাট ও ব্যাপক। আজানের এই ভূমিকা ইসলামী ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত। সাধারণভাবে আজানের শাব্দিক অর্থ ঘোষণা করা, আহŸান করা। শরীয়তের পরিভাষায় এর অর্থ হচ্ছে, নামাজের সময় হাদিসে বর্ণিত বিশেষ শব্দাবলীর মাধ্যমে ঘোষণা বা আহŸান করা। তবে চালু না থাকলেও হযরত ইবরাহীম (আ.) হজ্ব করার জন্য আবু কোরাইশ পর্বতে আরোহণ করে একটি ঘোষণা প্রচার করেছিলেন বলে জানা যায়। সম্ভবত উদ্দেশ্য ছিল, অনেক দূরের লোকেরাও যেন ঘোষণা শুনতে পায়। কানে আঙ্গুল দিয়ে শব্দ উচ্চারণ করলে আওয়াজ অধিক বুলন্দ হয়। সূরা হজ্বে আল্লাহ্ তায়ালা ঘোষণা করেন, এবং মানুষের মধ্যে হজ্বের জন্য ঘোষণা প্রচার কর।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তফসীরকারগণ উল্লেখ করেছেন যে, হযরত ইবরাহীম (আ.) দুই কানে অঙ্গুলি রেখে ডানে-বামে, পূর্ব-পশ্চিমে মুখ করে তার ঘোষণা প্রচার করেন। ইসলামে প্রবর্তিত আজানের সময় দুই কানে অঙ্গুলি রাখার বিধান রাখার আসল উদ্দেশ্যও অনুরূপ হওয়া স্বাভাবিক।
রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর মক্কী জীবনের তের বছরের মধ্যে তাবলীগ প্রচারে নানা বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান ছিল। হিজরতের পর মদনী জীবন শুরু হলেও প্রথম দিকে জামাতসহকারে নামাজ আদায় করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। লোকেরা অনুমানের ভিত্তিতে ওয়াক্ত নির্ধারণ করে নামাজ আদায় করত। এই ব্যবস্থা রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর পছন্দ ছিল না। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, কিছু লোককে নিয়োগ করা দরকার যারা নামাজের সময় হলে লোকদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের ডেকে আনবে। কিন্তু বিভিন্ন রকমের অসুবিধা ছিল। তিনি সাহাবায়ে কেরামের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করেন।
বিভিন্নজনে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেন। কেউ বললেন, নামাজের সময় মসজিদে একটি আলামত দাঁড় করিয়ে দেয়া হোক, লোকেরা তা দেখে আসতে থাকবে। হুজুরে (স.)-এই পদ্ধতি না পছন্দ করলেন। নামাজের ঘোষণার জন্য খ্রিস্টান ও ইহুদিদের নিকট যেসব পদ্ধতি প্রচলিত ছিল সেগুলির কথা তার খেদমতে পেশ করা হলো। কিন্তু তিনি হযরত উমর (রা.)-এর মতকে পছন্দ করলেন এবং হযরত বেলাল (রা.)-কে আজান দেয়ার নির্দেশ প্রদান করলেন। এতে একদিকে নামাজের সাধারণ ইত্তেলা হয়ে যায়, অপরদিকে দিনে পাঁচ বার ইসলামের প্রতি দাওয়াতের ঘোষণাও হয়ে যায়।
প্রচলিত আজানের প্রস্তাব কে পেশ করেন সে সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। একটি মত অনুযায়ী, হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে জায়দ (রা.) ছিলেন প্রথম প্রস্তাবক, তিনি স্বপ্নযোগে আজান অবগত হয়েছিলেন। অপর এক বর্ণনা মতে, হযরত উমর (রা.) ও অনুরূপ স্বপ্ন দেখেন। তবে ভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, হযরত উমর (রা.) অন্যদের মতামতের বিপরীত নিজস্ব মত এইভাবে ব্যক্ত করেন। অর্থাৎ- নামাজের ঘোষণা করার জন্য এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করা হোক। বোখারীতে বর্ণিত হযরত উমর (রা.)-এর এই মতকে রাসূলুল্লাহ্ (স.) পছন্দ করেন এবং তিনি আসসালাতু জামেয়াতুন এই বাক্য উচ্চারণ করে নামাজের ঘোষণা প্রচার করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (স.) নিজেও স্বপ্ন দেখেন এবং অন্যান্য সাহাবীও স্বপ্নে প্রচলিত আজানের শব্দাবলীর সাথে আজান স্বপ্নে অবগত হন। রাসূলুল্লাহ্ (স.) এই আজান আল্লাহর পক্ষ হতে বলে মনে করে তা গ্রহণ করেন এবং সেই মোতাবেক প্রচলিত আজান চালু করা হয়।
আজান প্রবর্তনের এই বিবরণ পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, নামাজের জন্য আহŸান করার রীতিপ্রথা ইহুদী, খ্রিস্টান ও অগ্নি উপাসকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (স.) সেগুলির একটিও গ্রহণ করেননি এবং অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে হযরত উমর (রা.)-এর প্রস্তাবকে তিনি গ্রহণ করেন যা তিনি স্বয়ং এবং অন্যান্য সাহাবী স্বপ্নযোগে অবগত হন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে জায়দ (রা.) সর্বপ্রথম স্বপ্নে আজান ও একামত জানতে পারেন। তিনি তার স্বপ্নের কথা রাসূলুল্লাহ্ (স.) কে জানালে তিনি বলেন, এই স্বপ্ন সত্য। এ সম্পর্কে হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ মোহাদ্দেস দেহলভী (র.) যে বিবরণ দিয়েছেন, তা নি¤œরূপ: স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত আজান ও একামতকে রাসূলুল্লাহ্ (স.) অক্ষুণœ রাখেন। আজানের শব্দাবলীর দ্বারা নামাজের জন্য আহŸান করার মাধ্যমে দূরের বা বেকার লোকদের নামাজের জন্য একত্রিত করার মধ্যে ইসলামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার শামিল এবং মুসলমানদের তা গ্রহণ করা দ্বীনে এলাহীর অনুসরণের নিদর্শন বা প্রতীক। এ কারণেই আজানকে আল্লাহর জিকির কালেমায়ে শাহাদাত এবং নামাজের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ- আজানকে এবাদতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর এটাই হচ্ছে আজানের ধর্মীয় দিক।
আজানের শব্দাবলী উচ্চারণের কয়েকটি পদ্ধতি বর্ণিত হলেও হযরত বেলাল (রা.) যে পদ্ধতিতে আজান দিতেন একে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে সঠিক পদ্ধতি বলে গণ্য করা হয়। এই পদ্ধতি অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর জমানায় প্রতিটি বাক্য দুইবার করে এবং একামতে একবার করে উচ্চারণ করা হত। তবে কাদকামাতিস সালাত দুই বার করে বলা হত। হযরত আবু মাহজুরা (রা.)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী, রাসূলুল্লাহ্ (স.) তাকে আজানে ১৯টি এবং একামতে ১৭টি বাক্য শিক্ষা দেন।
আজান পরিপূর্ণভাবেই আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনি নিদর্শন বা প্রতীক। জামাতসহকারে নামাজ আদায়ের জন্য মানুষ আহŸান করার ব্যাপারেও ইসলাম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করেছে। তাই অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করার প্রস্তাবকে রাসূলুল্লাহ্ (স.) সরাসরি এই বলে প্রত্যাখান করেছেন যে, এটি মজুসি বা অগ্নি উপাসকদের একটি সির্কি কুপ্রথা, মুসলমানরা তা গ্রহণ করতে পারে না। নাসারা খ্রিস্টানদের সাথে মিল থাকার কারণে তাদের নাকুর্স বা ঘন্টা বাজানোর প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখান করেন। ‘বুক’ নামক এক প্রকারের সিঙ্গা বাজানোর প্রচলিত রীতি অনুসরণের প্রস্তাবও রাসূলুল্লাহ্ (স.) নাকচ করেছেন। এসব প্রথার প্রত্যেকটি ছিল আল্লাহ তায়ালার ওয়াহদাত- একত্বের পরিপন্থী, পৌত্তলিকতার পরিচায়ক। সুতরাং নামাজকে এসব কুপ্রথার মিশ্রণ হতে পবিত্র রাখার জন্য আজান প্রবর্তন করা হয়।
ইসলামে আজানের প্রতি এত অধিক মর্যাদা প্রদর্শন করা হয়েছে যে, জেহাদ অভিযানকালে রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর নির্দেশ ছিল যে, মুসলিম বাহিনী কোন এলাকায় অভিযান পরিচালনাকালে যদি ঐ এলাকায় আজানের শব্দ শুনা যায় তাহলে সেখানে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা থেকে বিরত থাকবে। কেননা, আজান প্রমাণ করে, ঐ এলাকায় মুসলমান রয়েছে এবং তারা জামাতে নামাজ আদায় করে। সুতরাং সেই মুসলিম জনবসতিতে আক্রমণ করা যাবে না। আজানের এই বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্যের প্রতি সাহাবায়ে কেরাম বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতেন এবং তাদের জীবনে এরূপ বহু ঘটনার দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায়।
মুসলমানের সামাজিক জীবনে আজানের প্রভাব নানাভাবে দেখতে পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগ দুর্বিপাক ও আপাতকালীন সময়ে আজান দেয়ার প্রথা প্রচলিত এবং অনেকেই বিশ্বাস করে বিপদাপদ ও বালামুসিবতে আজান বিপদ মুক্তির কারণ হয়ে থাকে। বিশেষত কলেরা মহামারীতে আজানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। এতদ্ব্যতীত প্রাকৃতিক বিপদ ভূমিকম্পের আজান দেওয়ার প্রথা সর্বত্র প্রচলিত। এটাও মুসলমানদের সাধারণ বিশ্বাস। অনুরুপভাবে অগ্নিকান্ডের সময়ও আজান দেওয়া মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত।
হযরত বেলাল (রা.)-এর আজান
রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর যুগে নির্ধারিত মোওয়াজ্জেনগণের মোট সংখ্যা ছিল চারজন। মদীনায় ছিলেন দুইজন মোওয়াজ্জেন- হযরত বেলাল ইবনে রেবা (রা.) ও হযরত আমর ইবনে উম্মে মাকতুম কোরেশী আমেরী (রা.)। শেষোক্ত ছিলেন কোবায়। আওেশৎনের নাম সাদ আল কারত (রা.), তিনি হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.)-এর মওলা বা মনিব ছিলেন। চতুর্থ মোয়াজ্জেনের নাম আবু মাহজুবা আওমা ইবনে মোগীরা জুমহী (রা.)। তিনি মক্কায় ছিলেন। এই চারজন মোওয়াজ্জেনের মধ্যে হযরত বেলাল (রা.) ছিলেন প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে সপ্তম ব্যক্তি। খানা-ই কাবায় তিনিই প্রথম আজান দেন। এটি ছিল হিজরী ৮ম সালের ২০ রমজান। মোতাবেক ৬৩০ সালের ১১ই ফেব্রæয়ারির কথা।
রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি সর্বশেষ আজান দেন খলিফা হযরত উমর (রা.)-এর আমলে। তিনি যখন বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করেন। খলিফার অনুরোধে তিনি এই আজান দেন। আজানের শব্দাবলীতে কোন প্রকারের রদবদল ছাড়াই অহীর মাধ্যমে ও সাহাবায়ে কেরামের স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত আজান অবিকল অব্যাহত থাকে। তবে হযরত উসমান (রা.)-এর খেলাফত আমলে তিনি যেসব সংস্কার ও উন্নয়ন সাধন করেন, তাতে জুমার নামাজের পূর্বে আজান প্রথা চালু করেন। যেমন ঈদের নামাজের পর খোতবা চালু করেন। খেলাফতে রাশেদা, খেলাফতে বনি উমাইয়া এবং খেলাফতে আব্বাসিয়া যুগ পর্যন্ত মূল আজানে কোন প্রকারের পরিবর্তন করার দৃষ্টান্ত না থাকলেও মিসরে ফাতেমীয় খেলাফত যুগে একাধিকবার আজানে পরিবর্তন আনার প্রয়াস চালানো হয়। কিন্তু আব্বাসীয় খলিফাগণ এই অবাঞ্ছিত উদ্যোগ বানচাল করে দেন। এর বিবরণ নি¤œরূপ, ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে আরবীতে প্রচলিত মূল আজানে কেবল ফাতেমীর খলিফারা হাইয়া আলা খায়রিল আমল এই বাক্যটি সংযোজনের ব্যর্থ চেষ্টা করলেও ইসলামী ইতিহাসের কোন যুগেই এবং মুসলিম দুনিয়ার কোথাও আরবীর পরিবর্তে অন্য কোন ভাষায় আজান প্রবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানা যায় না মোস্তফা কামাল পাশা ব্যতীত। উসমানীয় খেলাফত উচ্ছেদের পর তুরস্কে আরবী ভাষারও উচ্ছেদ সাধন করেন এবং তিনি তুর্কি ভাষায় আজান প্রবর্তন করেন। এক্ষেত্রে একজন বাংলাদেশী পর্যটকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি গত শতকের চল্লিশের দশকে তুরস্কসহ বিভিন্ন আরবদেশ সফর করে একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত রচনা করেন। তুরস্কে সফরে গিয়ে তিনি যে পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেন তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আজান সম্পর্কে এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন।
অত্যাধুনিক আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে ইসলাম প্রচারের যেসব উন্নত ব্যবস্থা পদ্ধতির সাথে আমরা পরিচিতি লাভ করেছি, তার বর্ণনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও আজানের প্রথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিগত কয়েক বছর থেকে বাংলাদেশের জাতীয় প্রচার মাধ্যম টেলিভিশনের মাধ্যমে হারামাইন শরীফের আজান প্রচারিত হয়ে আসছে। আজান প্রচারের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ সর্বাধুনিক ব্যবস্থা।
আজান শুনে শয়তান পালায়
আজান আল্লাহর এক অপূর্ব অবদান। নামাজের জামাতে শরিক হওয়ার জন্য আজানের ভূমিকা অতুলনীয়। আজানের শব্দ যতদূর পর্যন্ত পৌঁছবে, তত বেশি লোক শ্রবণ করবে। দুই কানে অঙ্গুলি দিয়ে আজান দিলে আওয়াজ অধিক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যায় বলে কানে অঙ্গুলি দিয়ে আজান দেওয়ার ব্যবস্থা। আজান শুনে যত বেশি লোক নামাজের জন্য আসবে জামাত তত বড় হবে যা জামাতের প্রধান লক্ষ্য। হাদীসে বর্ণিত, আজান আল্লাহর পক্ষ হতে এমন এক শক্তিশালী অস্ত্র যে, এর শব্দ শুনে শয়তান পর্যন্ত বায়ু ছাড়তে ছাড়তে পলায়ন করে।
আজানের জবাব
আজানের মর্যাদা ও তাৎপর্যের প্রতি লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, আজান শুনার সাথে সাথে এর জবাব দেওয়াটাও জরুরি। আর এই জবাব দেওয়ার দুইটি পদ্ধতি রয়েছে। একটি হচ্ছে মোয়াজ্জেনের আজান বলার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাও তা উচ্চারণ করবে এবং অপরটি হচ্ছে আজান শুনে জামাতে উপস্থিত হওয়া। এমনকি শরয়ী ওজর ব্যতীত জামাত তরক করার বিধান নেই। মসজিদ পর্যন্ত গমন করতে সক্ষম অন্ধ ব্যক্তির পক্ষে আজান শুনলে জামাতে উপস্থিত না হওয়ার অনুমতি নেই। উল্লেখ্য যে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) ছিলেন অন্ধ সাহাবী। একবার তিনি রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে জামাতে শরিক হওয়া তার জন্য জরুরী কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। রাসূলুল্লাহ্ তাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কি আজান শুনতে পাও? আবদুল্লাহ্ (রা.) বললেন, হ্যাঁ, শুনতে পাই। আর জামাতে নামাজ আদায় করার তাৎপর্য আলাদা।
সন্তান জন্মের পর আজান
মুসলিম পরিবারে সন্তান জন্মের পর তার কানে আজান একামত বলা আকিকা করার মতই ইসলামী নিদর্শন প্রথা। রাসূলুল্লাহ্ (স.) নিজের ঘর থেকেই এই প্রথার সূচনা করেন। হযরত আলী (রা.) ও হযরত ফাতেমা (রা.)-এর পুত্র হযরত ইমাম হাসান (রা.) যখন জন্মগ্রহণ করেন রাসূলুল্লাহ্ (স.) খোদ তার কানে আজান দেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আজানের শব্দ শুনে শয়তান পলায়ন করে থাকে। একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, সন্তানের ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় শয়তান তাকে কষ্ট দেয় বলে সন্তান চিৎকার করে ওঠে। এ কারণেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার কানে আজান দেয়ার প্রথা চালু করা হয়। যাতে প্রাথমিক অবস্থায় শয়তানের স্পর্শ হতে সে রক্ষা পায়। সাধারণত সব মুসলিম পরিবারেই নবজাতকের কানে আজান বলাটা একটি সামাজিক ঐতিহ্য হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, যেসব সন্তান বর্তমান যুগে হাসপাতাল-ক্লিনিক ইত্যাদিতে জন্মগ্রহণ করে থাকে তাদের মাতাপিতা বা অভিভাবক বা কোন কর্তৃপক্ষের সেখানে ওদের কানে আজান দেওয়ার কোন রকমেই সুযোগ না ঘটে তবে বাসাবাড়ি নিয়ে আসার পর বিলম্বে হলেও আজানের ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি নিয়ম মোতাবেক আজানের ব্যবস্থা করা কিছুতেই সম্ভব না হলে মাতাপিতা বা অভিভাবকগণ মসজিদে আজানের সময় নবজাতকের কানে সেই আজানের শব্দ শুনানোর বিকল্প ব্যবস্থা করে থাকেন। এতে বুঝা যায় যে, আজানের প্রতি মুসলমানদের অগাধ ভক্তি, বিশ্বাস ও মর্যাদা প্রদর্শনের অনুভূতি বিশেষ কাজ করে থাকে। সমাজ জীবনে এটি আজানেরই গভীর প্রভাবের পরিচায়ক বৈ কিছু নয়।
আজানের সময় মহিলারা মাথায় কাপড় দেন কেন?
এখানে একটি অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এসে যায় এবং তা হচ্ছে যে, কোন আজানের সময় আমাদের সমাজের মহিলাদের অনেককেই মাথায় কাপড় দিতে দেখা যায়, এর কারণ কী? জবাবে বলা যায় যে, উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন এটি একটি শুভ লক্ষণ, যেসব মহিলা মাথায় ঘোমটা বা কাপড় রাখতে অভ্যস্ত নন অন্তত আজানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে মাথায় কাপড় দিয়ে থাকেন। এই ধর্মীয় অনুভূতি প্রশংসার যোগ্য। এটি আজানের একটি সামাজিক ঐতিহ্য বলে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।
জুমার আজান
পাঞ্জেগানা নামাজের আজানের ন্যায় জুমার নামাজের আজানও ইসলামী বিধান। জুমার জন্য দুইটি আজানই প্রচলিত। প্রথম আজানের উদ্দেশ্য লোকদেরকে নামাজের জন্য মসজিদে আগমনের জন্য খবর করা। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে জুমার দিন যখন নামাজের জন্য আজান দেয়া হয় তখন তোমরা আল্লাহর জিকির-এর দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা বন্ধ রাখ। এই আয়াতের বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে। সেই আলোচনায় প্রবৃত্ত না হয়েও বলা যায় যে, মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন জুমাবারেরর এই আজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। এরপর দ্বিতীয় আজান হয় খোতবার পূর্বে এবং নামাজের পূর্বে একামত দিতে হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন