মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

তাদের স্বেচ্ছায় নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে সরে যাওয়া উচিত

প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গুরুতর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রী আ ফ ম মোজাম্মেল হক। তারা ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদ-ে দ-িত হয়েছেন। সাত দিনের মধ্যে এই অর্থ দাতব্য প্রতিষ্ঠান ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ও লিভার ফাউন্ডেশনকে দিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় তাদের বিনাশ্রমে সাত দিনের কারাদ- ভোগ করতে হবে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের আট সদস্যের বেঞ্চ গত রোববার তাদের দোষী সাব্যস্ত করে এই দ- প্রদান করেছেন। দুই মন্ত্রী নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার পরও সর্বোচ্চ আদালত এই দ-াদেশ প্রদান করেছেন। আদালত বলেছেন : ‘দুই মন্ত্রী নিঃশর্ত ক্ষমা ও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে যে আবেদন করেছেন তা গ্রহণ করতে আমরা অপারগ। আবেদনকারীরা মন্ত্রী, সাংবিধানিক পদাধিকারী। তারা সংবিধান রক্ষায় শপথবদ্ধ। প্রধান বিচারপতি ও সর্বোচ্চ আদালতকে অবমাননা করে তারা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা আমাদের কাছে উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হয়েছে। তাদের বক্তব্য বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপের শামিল এবং বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণœ করেছে। যদি তাদের ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে যেকোনো ব্যক্তি বিচার বিভাগ সম্পর্কে একই রকম অবমাননাকর বক্তব্য দেবেন। এ জন্য তাদের গুরুতর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। তবে প্রথম সুযোগেই তারা নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ায় সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে উদারতা দেখানো হয়েছে।’ এর আগে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা সব বিচারক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করেছি।..... আমরা আদালত অবমাননা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাই না। শুধু দু’জন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রসিডিংস ড্র করেছি সারা জাতিকে একটি বার্তা দেয়ার জন্য। ভবিষ্যতে যেন কেউ এ ধরনের অবমাননার পুনরাবৃত্তি না করেন। তারা দেখুক আমরা কত কঠোর হতে পারি।’
নিঃসন্দেহে এটি সর্বোচ্চ আদালতের একটি ঐতিহাসিক রায়। এর আগে দুর্নীতির দায়ে দ-িত একজন মন্ত্রী এবং আদালতের রায়ের পরও আইনের সুযোগ নিয়ে অপর একজন মন্ত্রী তাদের মন্ত্রিত্ব ও সংসদ সদস্যের পদ ধরে রাখতে পারলেও এই প্রথম দু’জন মন্ত্রী আদালত অবমাননার দায়ে দ-িত হলেন। এটা একটা নজির, যা অন্য কারো আদালত অবমাননা করা থেকে বিরত রাখতে ভূমিকা রাখবে বলে সকলেই মনে করেন। আদালতের মর্যাদা সম্পর্কে নতুন করে বিস্তারিত বলার অবকাশ নেই। প্রধান বিচারপতি, বিচারকবৃন্দ এবং আদালত সম্পর্কে এমন কোনো বক্তব্য রাখা উচিত নয় যাতে তাদের সম্মান ও মর্যাদা বিন্দুমাত্র ক্ষুণœ বা ব্যাহত হয়, তাদের সম্পর্কে জনমনে ন্যূনতম বিভ্রান্তি বা অনাস্থা সৃষ্টি হয়। দুই মন্ত্রীর আদালত অবমাননার রায়ে স্পষ্টই বলা হয়েছে, তাদের বক্তব্য ‘গুরুতর’ আদালত অবমাননাকর। তারা তাদের বক্তব্যের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়ে দ-িত হয়েছেন। তাদের দ- আরো বেশি বা কঠোর হতে পারত। এ ক্ষেত্রে আদালত উদারতা প্রদর্শন করেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত রুলের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি আরো কিছু কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, মন্ত্রীরা শুধু প্রধান বিচারপতিকে ছোট করেননি, গোটা বিচার বিভাগকে পদদলিত করেছেন। বলেছিলেন, তারা ফৌজদারি অপরাধ করছেন। বলেছিলেন, তারা শপথ ভঙ্গ করেছেন, সংবিধান লংঘন করেছেন। যা হোক, রায় হওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, দ-িত হয়ে মন্ত্রীদ্বয় স্বপদে বহাল থাকতে পারেন কি না। সংবিধানে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশনা নেই। যদি নাও থাকে, অনেকেই মনে করেন, দ-িত হওয়ার পর মন্ত্রীদ্বয় মন্ত্রীপদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, সংবিধানে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে এর সঙ্গে নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত। মন্ত্রিসভা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ অবশ্য মনে করেন, আদালত অবমাননায় সাজাপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রীর পদে বহাল থাকতে বাধা নেই। আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, এ বিষয়ে আইন নিশ্চুপ। কোনো আইনে এ সংক্রান্ত বিধান নেই। তবে এটা নীতি ও মূল্যবোধের ব্যাপার। দুই মন্ত্রী দ-িত অপরাধী। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দৃষ্টিতে এমন ব্যক্তিরা মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন না। হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, সাংবিধানিক পদাধিকারী শপথ ভঙ্গ করলে ওই পদে বহাল থাকার অযোগ্য হয়ে পড়েন। দ-িত হয়ে দুই মন্ত্রী মন্ত্রীপদে থাকার নৈতিকতা হারিয়েছেন। দলমত নির্বিশেষে অধিকাংশ আইনজীবীই মনে করেন, তারা নৈতিকভাবে মন্ত্রীপদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বিদায়ী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অবিলম্বে দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন।
মন্ত্রীদ্বয় স্বপদে বহাল রয়েছেন। গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকেও তারা হাজির ছিলেন। নৈতিক দায় স্বীকার করে তারা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন, এমনটি এখন পর্যন্ত প্রতীয়মান হচ্ছে না। গতকালের মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত জানা যায়নি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবও জানা যায়নি। তবে তাদের এ ধরনের বক্তব্য যে প্রধানমন্ত্রী পছন্দ করেননি, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন, একথা কথা আগেই মিডিয়ায় এসেছে। যেহেতু দ-িত হওয়ায় মন্ত্রীদ্বয় নৈতিকভাবে পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন, আমাদের মনে হয়, সে কারণে স্বেচ্ছায়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মন্ত্রিত্ব থেকে সরে যাওয়া উচিত। যদি তারা এটা না করেন তবে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে রাখতে পারেন কার্যকর ভূমিকা। বলা বাহুল্য, দ-িতদের মন্ত্রীপদে বহাল রাখা হলে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হবে এবং একটি ব্যতিক্রমী নজির সৃষ্টি হবে। এই পটভূমিতে সব কূল রক্ষা হতে পারে যদি তারা নিজেরাই পদত্যাগ করে সরে দাঁড়ান।

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন