সংবাদ মাধ্যমগুলো থেকে প্রায় প্রতিদিন আমরা নারী নির্যাতনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারি। দিন কয়েক দেখলাম, সময়ে রান্না না- করার অপরাধে একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীর মাথা কেটে ফেলেছেন। শিক্ষক তাঁর ঘুমন্ত স্ত্রী ও মেয়েকে খুন করেছেন। এমন গুরুতর অপরাধের পর মৃতার সন্তানদের মতো আমরাও অপরাধীর মৃত্যুদন্ডের মতো চরম শাস্তি ছাড়া আর কীই বা চাইতে পারি? কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেই কি এই ধরনের নির্যাতন থেকে মহিলারা নিস্তার পাবেন?
দীর্ঘদিন থেকে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত থাকার সুযোগে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কীভাবে প্রতিদিন মহিলারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। দেখেছি, স্ত্রী কিংবা পুত্রবধুকে নির্যাতন করা বা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কারণগুলো বড়োই অদ্ভুত। উভয় পক্ষকে নিয়ে মিটমাট করার উদ্দেশ্য আয়োজিত আলোচনা সভায় দেখেছি, বাজারের ফর্দের মতো পুত্রবধুর বিরুদ্ধে লম্বা অভিযোগের ফর্দ। তাতে যেমন আছে যৌতুকের সাইকেল, টিভি না- পাওয়ার মতো অভিযোগ, তেমনই উঠোন ঝাড়– দেওয়ার সময় ধুলো ওড়ানো কিংবা হলুদ বাটার পর শিলনোড়া ভালোভাবে না ধুয়ে মশলা বাটার মতো অভিযোগগুলোকে অতি যতেœ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই অভিযোগগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে মধ্যস্থতা করে মেয়েটিকে স্বামীর বাড়ি ফেরানোর কাজটি যত না কঠিন, তার থেকেও বেশি কঠিন ছিল মেয়েটির জীবনে নিরাপত্তার অভাব, অনিশ্চয়তা। মেয়েটির মানসম্মান দেখার কোনো সুযোগ ছিলই না।
পণ বা যৌতুকের দাবি বা সাংসারিক খুঁটিনাটি অপরাধের কারণেই যে কেবলমাত্র মেয়েদের বিতাড়িত হতে দেখছি তা নয়। পাঁচ সন্তানের মা খালেদা স্বামীকে লুকিয়ে লঙ্কার কৌটাতে গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট রেখেও আত্মরক্ষা করতে পারেনি। শেষমেষ যে দিন খালেদার স্বামী লুকিয়ে রাখা গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট খুঁজে পান, সেদিন কোলের তিন বছরের সন্তানসহ পাঁচটি সন্তানকে কেড়ে নিয়ে খালেদাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। লুকিয়ে বাচ্চাদের দেখতে গেলে পথেঘাটে খালেদাকে তাঁর স্বামী মারধর করতেন। থানা পুলিশ, আইন আদালত করার সামর্থ্য ছিল না। ভয় ছিল পাছে সারা জীবনের জন্য সন্তান ও মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারাতে হয়।
সাধারণভাবে পণপ্রথাকেই নারী নির্যাতনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে আমরা মনে করে থাকি। কিন্তু পণ প্রথা ছাড়াও নারী নির্যাতনের ঘটনার পিছনে অন্যান্য আরও অনেক কারণ খুব কাছ থেকে দেখছি। বাইশ বছরের সালমার (নাম পরিবর্তিত) মায়ের সঙ্গে প্রত্যন্ত একটি গ্রামে গিয়ে দেখেছিলাম ডাক্তার দেখানো সত্তে¡ও বিয়ের তিন বছর পরও সন্তান না হওয়ার কারণে শারীরিক নির্যাতনের পর সালমা মারা গেছে ধরে নিয়ে তাঁর স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা রাতের অন্ধকারে বস্তাবন্ধি করে সালমার দেহ খালের ধারে ফেলে দেয়। ভোর রাতে সালমার জ্ঞান ফিরলে গোঙানির শব্দে গ্রামবাসীর চোখে পড়ে। তারাই সালমার বাড়িতে খবর দেয়। থানা পুলিশ আইন আদালত সবই হয়েছিল। মাস তিনেক পর সালমার স্বামী জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর একদিন হঠাৎ সালমা বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর সঙ্গে পালিয়ে যায়।
ঘটনাটি আমাকে খুবই বিচলিত করে, মনে হয়েছিল সম্ভাব্য বিপদের কথা সালমাকে বোঝাতে খামতি ছিল। এর কিছু দিনের মধ্যে সালেমার সঙ্গে হঠাৎই দেখা হলে বলেছিল ‘ভাই রাগ করো না। স্বামী বলল, কেস তুলে নিলে আমাকে নিয়ে আবার সংসার করবে। বাচ্চা হচ্ছে না বলে স্বামী এতদিন ডাক্তার দেখাত না, এবার দেখাবে বলেছে। স্বামীর কথা বিশ্বাস না করে কী করব বলুন? ভাই, ভাইয়ের বউয়ের সংসারে থাকতে ভয় লাগে। বাপ-মা যখন মরে যাবে, তখন কী করব বল? বাপের ঘর, শ্বশুর ঘর যেখানেই থাকি জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতেই হবে। সে বার যে মরে যাইনি সেটা ওরা বুঝতে পারেনি। এবার মারবে মনে করলে ঠিক মেরে ফেলবে, আর ভুল করবে না। বাপের ঘরের লোকরা তো আর জানে মারবে না, সারা জীবন লাথিঝাঁটা সহ্য করে থাকতে হবে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে অত্যাচারী স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার এমন অখÐ যুক্তিকে অস্বীকার করিই বা কী করে? সালমার স্বামীর পাঁচ কিংবা দশ বছরের সশ্রম কারাদÐ হলেও কি সালমাদের সমস্যার সমাধান হতো? যে কয়েকটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা দেখেছি, সেগুলো যে দৃষ্টান্তমূলক হয়নি তার প্রমাণ তো আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি।
এ কথা আমরা অনেকেই জানি যে, মহিলাদের শিক্ষা ও আর্থসামাজিক অবস্থান পরিবর্তন করতে না পারলে এই ধরনের সমস্যা থেকে বেরনোর জন্য দেশের আইন, সামাজিক সচেতনতা ছাড়াও বিকল্প পথ খোঁজার কাজটিও বড়ো কঠিন। ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত নারী নির্যাতনের যেসব ঘটনা নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি তা দেখে ভীষণ শংকিত হচ্ছি। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় দুই আড়াই বছর ধরে ১৮০টি গ্রামে গবেষণার কাজে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতার এতটুকু পরিবর্তন দেখিনি। আজও পণ ছাড়া কন্যা সন্তানের জন্ম, সন্তান না-হওয়া, গায়ের রং, অসুন্দর চেহারার মতো কারণগুলোর সঙ্গে আছে স্ত্রীর শরীর-মনসহ সব কিছুর ওপর স্বামীর একচেটিয়া দখলদারি ও একাধিপত্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এই দখলদারিত্বের বিশ্বাস এত গভীর যে, সাক্ষাৎকারে অনেক স্বামী যে তাঁর স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করেন সে কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। মানসিক নির্যাতনের কথা তো ছেড়েই দিলাম ‘প্রয়োজন পড়লে তো একটু আধটু শাসন গালিগালাজ করতেই হয়’ গোছের অকপট স্বীকারোক্তি। একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীর মাথা কেটে নিয়েছেন শুনলে আপাতদৃষ্টিতে এটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সত্তা থেকে আসা ক্ষমতার বোধ কীভাবে ব্যক্তির আচরণ, মানসিকতা ও বিশ্বাসকে প্রভাবিত করতে পারে, সেটি দেখা যায় গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, জনে জনে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু পুরুষদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মাঠ থেকে কাজ করে ফিরে যদি দেখেন তখনও তাঁর স্ত্রী রান্না করেনি, তখন কি আপনার মাথা গরম হয়ে যায়? শ’দুয়েকের বেশি স্বামী উত্তর দিয়েছিলেন ‘হ্যাঁ, তা তো হয়। দিই দু’ঘা বসিয়ে, কোনো কোনো দিন হাতের কাছে যা পাই ছুড়ে মারি। খাওয়া-দাওয়া বিশ্রামের পর মাথা ঠান্ডা হয়, তখন আবার মিলমিশ হয়ে যায়।’
এসব দেখেশুনে দ্বিধা লাগে। নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘোরতর অন্যায় ও অপরাধের, একথা স্বীকার করেও মাঝে মাঝে মনে হয় পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ছাড়াও পুরুষদের শ্রম, ক্লান্তি কিংবা দারিদ্র্যের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই কি তাদের অত্যাচারী করে তুলেছে? ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে ৪৫ বছরের প্রতিমা দেবী দাওয়ায় বসে বলেছিলেন, ‘এই যে আমার সংসারে টিভি, শো-কেস যা কিছু দেখেছেন, সব ওই মানুষটা গতরে খেটে করেছে। কিন্তু মানুষটার শরীর ভালো নেই। পেরাই পেরাই জ্বর হয়। ওই দেখুন দু’দিন ধরে জ্বর, তাও মাটি কাটছে। এখন কিছু বলতে গেলে গালাগাল মারধর করবে। অন্য সময় মানুষটা ভালো। সংসারের লেগে খাটে, ভালোমন্দ নজর করে।’ এভাবেই নির্যাতনের পরস্পরাগত সংস্কৃতিসহ নানা কারণে মহিলাদের ওপর ঘটে চলা দৈনন্দিন অত্যাচারের কতটুকুই বা আমরা জানতে পারি? চরম ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি-দাওয়া করা আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের পক্ষে অনেক সহজ।
পণ কিংবা নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশে আইনকানুন থেকে যোজন খানিক দূরে সাধারণ মানুষের অবস্থান। আইনের সাহায্য না-নেওয়ার একটি বড় কারণ আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা। সে কারণে রাষ্ট্র এ ধরনের অত্যাচার থেকে মহিলাদের রক্ষা করতে পারে না। চরম পরিস্থিতিতে মহিলারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচার চাওয়ার কথাই ভাবে না। থানায় না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, মারধর করে স্বামী আমাকে থানায় যাবার জন্য বাস ভাড়া দেবে? কে যাবে আমার সঙ্গে? ভয় লাগে স্বামী যদি বাচ্চা কেড়ে নিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়।
এই অসহনীয় জীবনের পরিণতি হিসেবে নিশ্চিত মৃত্যুর পথ কেবলমাত্র সালমারাই খোঁজে না, বাকি যাঁরা খোঁজেন, তাঁদের মধ্যেই একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। জুন মাসের গরমে সঙ্গী সহকর্মীকে নিয়ে হাজির হয়েছিলাম কল্পনার বাড়িতে। ঘরের এক কোণায় বসে আমার সহকর্মী প্রশ্নপত্র হাতে প্রশ্ন করে, জানতে চায়- সংসারের কাজকর্ম করতে দেরি হলে স্বামী রেগে যান কি না?
অতি কষ্টে আগলে রাখা ব্যথা বাঁধ মানে না, আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন, বলেন- ‘ভাই, স্বামী এত মারধর করে, গালাগালি করে যে দিনের বেলায় বাইরে বেরোতে আমার লজ্জা লাগে। তাই অন্ধকার থাকতে সব কাজ করে নেই। আমার জামাই ভালো, মেয়েকে মারধর করে না। ছেলে বিএ পাস করেছে। আমার ওদের কথা মনে হয় না। আল্লাহর কাছে ছেলের জন্য চাকরি চাওয়ার কথা মনে পড়ে না। যতক্ষণ জেগে থাকি আমি শুধু আল্লাহর কাছে বলি আল্লাহ আমায় মৃত্যু দাও।’
এই কষ্ট, এই আহাজারি কবে বন্ধ হবে কে জানে! স্বামীরা স্বামী হওয়ার সাথে সাথে মানুষ কবে হবে , সেটাই প্রশ্ন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন