চিকিৎসাশাস্ত্র মতে, তার নাম ডায়াবেটিস। বাংলায় মধুমেহ। যে-নামেই তাকে ডাকা যাক না-কেন, তাতে বিপদের মাত্রা বিন্দুমাত্র কমে না। এই রোগ ক্রমশ বিশ্বজুড়ে মহামারির আকার নেবে বলেই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ক্রমশ লাগামহীন বাড়তে শুরু করেছে। তাই একটি ব্যাপারে সকলেই একমত যে, এই ২০৩০ সালে বিশ্বের ‘ডায়াবেটিস রাজধাণী’ হয়ে উটবে বাংলাদেশ। এই ডায়াবেটিস নিয়ে আর অনেক বেশি সচেতনতার প্রয়োজন, কারণ এই রোগের প্রকোপে চোখ আর কিডনির বারোটা বেজে যায়। কিন্তু সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে রোগটিকে ঠেকানো যায়। মনে রাখতে হবে, রোগের প্রথম স্তরে ট্যাবলেট দিয়েই কাজ হয়। ডায়াবেটিস নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে কারণ, ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। হার্টের রোগের ক্ষেত্রেও অনুঘটকের কাজ করে। তাছাড়া ‘ডায়াবেটিক ফুট;-এর কথা জানে। পায়ে সংক্রমণ থেকে গ্যাংগ্রিন। সেখানে থেকে সেপটিসিমিয়া হয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই এত চিন্তা। উদ্বেগের পারদও তাই চড়চড় করে বাড়ছে।
একশ’টি ‘কার্ডিও ভাসকুলার ডেথ’ হলে দেখা যায়, এর মধ্যে ২৫-৩০ জনের ডায়াবেটিস ছিল। এই অনুপাতটা ক্রমশ বাড়ছে। মানুষ কিডনির চিকিৎসার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে প্রস্তুত। ডায়ালিসিস করাতে প্রস্তুত অথচ, ডায়াবেটিস চিকিৎসা করাতে রাজি নয়। এটাই সমস্যা। এই রোগটা হলো ময়াল সাপের মতো। আস্তে আস্তে রোগীকে গিলে ফেলে। তাই হার্টের অসুখ হলে মানুষ যতটা তৎপর হয়, ডায়াবেটিসে হয় না। অথচ সঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে ডায়াবেটিসকে ঠেকানো যায়। নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ থাকা যায়। সব থেকে বড়ো সমস্যা হলো এ রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক ভুল ধারণা আছে। বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন, ইনসুলিন নেয়া শুরু করলে জীবন বরবাদ হয়ে গেল। যতক্ষণ ‘ট্যাবলেট’ ততক্ষণ ঠিক আছে। ইনজেকশন শুরু হলেই ডাক্তার বোধহয় টাকা কমানোর জন্য রোগীকে ইনজেকশন দিচ্ছেন। কিংবা এই ডাক্তার কিছু জানে না। বলা বাহুল্য, এই ভুল ধারণার জন্য কিছু ডাক্তারও দায়ী। রোগী ধরে রাখার জন্য অনেক ডাক্তারই ইনসুলিনের বদলে ‘ট্যাবলেট’ দিচ্ছে এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আরে বাবা সমস্যাটা বুঝতে হবে। বিজ্ঞানটা বুঝতে হবে।
অগ্ন্যাশয়ে সমস্যা থাকলে ইনসুলিন হরমোন শরীরে কাজ করতে পারে না। গ্লুকোজ ভেঙে শক্তি উৎপাদনে এই হরমোন মুখ্য ভূমিকা নেয় মানবদেহে। যাদের ছোটো থেকেই অগ্ন্যাশয় খারাপ তারা ‘টাইপ ১’ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ছোটদের হয় বলে একে জুভেনাইল ডায়াবেটিসও বলা হয়। আর যাদের বয়সের সঙ্গে অগ্ন্যাশয় খারাপ হয়, তাদের শরীরেও ইনসুলিন কাজ করে না। এ হলো ‘টাইপ ২’ ডায়াবেটিস। টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে তো ছোটো থেকেই ইনসুলিন নিতে হয়। এখানে কোনও বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। সমস্যা হল টাইপ ২ নিয়ে। এই ধরনের ডায়াবেটিসের প্রথম স্তরে ট্যাবলেট দিয়েই কাজ হয়। অগ্ন্যাশয় যত খারাপ হতে থাকে তত ট্যাবলেটের ডোজ বাড়তে থাকে। একটা সময় ট্যাবলেট আর কোনও কাজ করে না। তখন ইনসুলিন দিতে হয়। এই পর্যায়টিকে বলে ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট’। (লাভা) এই লাভা স্তরে ইনসুলিনের কোনও বিকল্প হয় না। এই সহজ সত্যিটাকে রোগীদের সামনে তুলে ধরতে হবে। বলতে হবে যে, কিডনি, চোখ ভালো রাখতে গেলে ইনসুলিন চাই।
আজকাল ডায়াবেটিসের জন্য নানরকম নন-অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনও শাখার বিরুদ্ধে কিছু না বলে একটা কথাই শুধু বলা যায়, রস্তুম হেকিমের উপদেশ মেনে যদি কেউ ব্লাড সুগারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তাহলে কিছু বলার নেই। নিমের মতো কিছু ভেষজ শর্করা নিয়ন্ত্রণ করার মতো রাসায়নিক আছে ঠিকই, কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, এগুলোর কোনওটাই ডায়াবেটিসের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। একটা পর্যায়ের পর ইনসুলিন নিতেই হবে। সেই সঙ্গে দরকার ঘাম ঝরানো শারীরিক কসরত। পরিমিত খাওয়া-দাওয়া। তাই সবার প্রথমে ইনসুলিন নিয়ে ভীতি দূর করতে হবে। তবে, এটা ঠিক, অ্যালোপাথিক ওষুধ দামি বলে অনেকেই বিকল্প উপায়ের খোঁজ করেন।
সুগার বাড়লে যেমন সমস্যা। সুগার কমলেও তাই। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই সুগার স্বাভাবিকের থেকে নিচে নেমে যায়। এমনটা হলে রোগীর বুক ধড়ফড় করে। হাত-পা কাঁপে। অস্বাভাবিক ব্যবহার করতে থাকে সে। কথা জড়িয়ে যায়। এদের দেখলে হঠাৎ করে মদ্যপ বলে ভুল হতে পারে। জুভেনাইল ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রেও এমন সমস্যা হতে পারে। এই ধরনের শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা উচিত। ক্লাস চলাকালীন এদের টিফিন খেতে দেয়া উচিত। একটা প্রচলিত ধারণা ছিল, শহুরে মানুষদেরই শুধু ডায়াবেটিস হয়। এই ধারণা কিন্তু ভুল। শহরের ১০-১২ শতাংশ মানুষের মধ্যে যদি ডায়াবেটিস থাকে, গ্রামের ৫-৬ শতাংশ মানুষের মধ্যেও এই রোগ রয়েছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় এই সত্য প্রমাণিত। আসলে, গ্রামের সঙ্গে তো শহরের দূরত্ব অনেক কমে গিয়েছে। লাইফ স্টাইলও বদলে গিয়েছে। গ্রামের মানুষ এখন আর শুধু চাষের ওপর নির্ভরশীল নয়। তা ছাড়া বিনোদনের হরেক উপকরণ পরিশ্রমবিমুখ করে তুলেছে গ্রামের মানুষকেও। সবশেষে একটা কথা বলা যায়, নিজেকে ডায়াবেটিস মুক্ত রাখতে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য লাখতে হবে। তিরিশের ঘরে থাকা যুবকদের বিশেষ করে বলা দরকার, ভুঁড়ি কোনওমতেই বাড়তে দেয়া যাবে না। স্ফুর্তিতে থাকতে হবে। দিনে অন্তত একটা সময় ৩০-৪০ মিনিট নিজেকে ‘রিল্যাক্সড’ রাখতে হবে। নিয়মিত সুগার পরীক্ষা করাতে হবে। কারও পরিবারে যদি ডায়াবেটিস থাকে তবে তাকে প্রতি বছর নিয়ম করে সুগার পরীক্ষা করানো উচিত। না-থাকলে ৫-৬ বছর পর পর করলেই হবে।
ষ আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক-কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন