শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সুন্দরবন ধ্বংসের ষড়যন্ত্র রুখতে হবে

প্রকাশের সময় : ৩০ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সুন্দরবন ধ্বংসের নানামুখী আয়োজন চলছেই। সুন্দরবনের বিপদসীমার মধ্যে দেশের বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে সুন্দরবনকে ধ্বংসের মুখোমুখি নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যখন প্রবলতর হয়ে উঠেছে, ঠিক তখন আবারো সুন্দরবনে বড় ধরনের অগ্নিকা- সংঘটিত হলো। আগুন লাগার প্রায় ১৯ ঘণ্টা পর সোমবার দুপুরের দিকে বনবিভাগের লোকজন, দমকল বিভাগ এবং স্থানীয় জনসাধারণ যৌথ প্রয়াসে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলি ক্যাম্প এলাকায় আগুন লেগে প্রায় ১০ একর বনভূমি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো কোনো রিপোর্টে উল্লেখ করা হলেও ঠিক কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, সে তথ্যে কিছুটা গরমিল লক্ষ করা যাচ্ছে। ঠিক একই স্থানে এর আগেও অগ্নিকা- ঘটেছিল বলে বনবিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়। গত মাসেও সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে আগুন লেগে ৪ একর বনভূমির গাছপালা পুড়ে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে গতকাল একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে অন্তত ১৮ বার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকা-ে প্রায় ৬০ একর বনভূমি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এসব অগ্নিকা-ের পেছনে স্বার্থান্বেষী মহলের নাশকতার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এবারও জেলেরা ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগিয়েছে বলে বনবিভাগের তরফ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। আগুন লাগার কারণ উৎঘাটনে ইতোমধ্যে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সুন্দরবন বাংলাদেশের এক অনন্য সম্পদ ও অবিচ্ছেদ্য ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের অংশ। এটি এখন শুধু বাংলাদেশের একক সম্পদই নয়, ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ওয়ার্ল্ড ন্যাচারাল হেরিটেজ’ ঘোষিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সুন্দরবন বিশ্বের সম্পদে পরিণত হয়েছে। এ কারণেই বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশের পরিবেশবাদী ও নাগরিক সমাজের পাশাপাশি বিশ্ব সম্প্রদায়েরও উদ্বেগের কমতি নেই। সুন্দরবনের যথাযথ সুরক্ষা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বাণিজ্যিক নৌ-চ্যানেল অব্যাহত রাখার বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী পরিবেশবাদী এবং নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ ও পরামর্শ শুরু থেকেই অগ্রাহ্য করা হয়েছে। সেখানে নানা ধরনের ভারী শিল্পের অনুমোদন, বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের সুযোগ অবারিত রাখা এবং দেশের বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ধ্বংসাত্মক উদ্যোগের বিষয়ে আমাদের সরকারের বেপরোয়া মনোভাব বিস্ময়কর। সুন্দরবনে বনদস্যুতা, বনের গাছ কেটে উজাড় করা এবং প্রায়ই অগ্নিসংযোগ করে ক্ষতিসাধনের যে ধারাবাহিক তৎপরতা চলছে, তার বিরুদ্ধে সরকার ও বনবিভাগের কার্যকর প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনুপস্থিত। প্রতিটি ঘটনার পরই একটি দায়সারা গোছের তদন্ত কমিটি গঠন করতে দেখা গেলেও তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশ ও তার বাস্তবায়ন কখনো আলোর মুখ দেখে না। এভাবেই সুন্দরবনের আয়তন, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে।
সুন্দরবনের বৃক্ষনিধন এবং বনভূমি দখলের লক্ষ্যে বনদস্যুদের নাশকতায় লিপ্ত থাকার অভিযোগ অনেক পুরনো। বছরের পর বছর ধরে সুন্দরবনকে এভাবে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষায় বনবিভাগের ব্যর্থতা অমার্জনীয়। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের গঠন এবং বিস্তৃতি অনুসারে ভারত-বাংলাদেশের সমুদ্রোপকূলীয় জলাভূমি, অনেকগুলো দ্বীপ ও চর মিলিয়ে সুন্দরবন অঞ্চলের সামগ্রিক আয়তন প্রায় ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার হলেও উভয় প্রান্তে নিবিড় বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর বেশিরভাগই পড়েছে বাংলাদেশ অংশে। তবে গত কয়েক দশকের অব্যাহত বৃক্ষনিধন, অগ্নিকা-, অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য আহরণ, অবৈধভাবে পশু শিকার এবং সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বাণিজ্যিক নৌযানের অবাধ যাতায়াত ও দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশের সুন্দরবন ক্রমাগত বিলীয়মান। সাম্প্রতিক বাঘ শুমারিতে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেলেও ভারতীয় অংশে বাঘের সংখ্যাবৃদ্ধির তথ্য পাওয়া যায়। একইভাবে বিরল প্রজাতির কুমির, মৎস্য ও ইরাবতি ডলফিনের সংখ্যাও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। সুন্দরবনের ভেতরে অয়েল ট্যাংকার, কয়লাবোঝাই জাহাজ, পাথর, রাসায়নিক সার ও বিষাক্ত কেমিক্যালবাহী জাহাজডুবিতে ম্যানগ্রোভ বনের বারোটা বাজছে। এসব দুর্ঘটনার সাথে সব সময়ই নাশকতা বা সাবোটাজের আলামত পাওয়া গেলেও অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হয় না। এবারো তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এভাবে এর সমাধান হবে না। সুন্দরবন রক্ষা এবং নাশকতার সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করতে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক তদন্তের ব্যবস্থা করা হোক। সুন্দরবন ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-ের মতো গুরু শাস্তির আইনগত ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি। সুন্দরবনে অগ্নিকা- অথবা নৌযান ডুবিয়ে বৃক্ষ, পানি এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের ষড়যন্ত্র রুখতে সংশ্লিষ্টদের জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন