শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মিথ্যায় ভাসছে দেশ

মাওলানা এরফান শাহ্ | প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ক্ষমতার লোভ ও মোহ এতবেশি, একবার স্বাদ পেলে পোড়ামাটিনীতি অবলম্বন করে হলেও তা ধরে রাখতে চায়। কারণ ক্ষমতায় থাকাকালে প্রতিহিংসা আর প্রতিপক্ষকে যেভাবে আঘাত করা হয়, ক্ষমতা হারানোর পর আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে সারা জীবন ক্ষমতা আকড়ে থাকতে চায়। কবিতার ভাষায় বলতে হয়, ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে/ তবে মরণ যে অবধারিত, সে কথা আর থাকে না মনে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় এ কথা সবাই বলে/ তবে ক্ষমতায় গেলে, সেকথা যায় একবারে ভুলে/ সদা সর্বদা থাকে ভিন্নমত আর বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন ‎করার তালে।’ কেয়ারটেকার প্রধানকে নিজের ভাগে আনতে কেউ বিচারপতির বয়স বৃদ্ধি করে, আবার কেউ আরো একধাপ এগিয়ে আদালতের দোহাই দিয়ে কেয়ারটেকার সিস্টেমটাই বাতিল করে। উদ্দেশ্য যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকতে হবে। জনগণের জন্য সংবিধান নাকি সংবিধানের জন্য জনগণ? উভয় পক্ষ দাবি করে, জনকল্যাণে রাজনীতি করে। অথচ দেশের স্বার্থে দু’দল এক টেবিলে বসেছে সেরকম কোনো উদাহারণ নেই বললেই চলে। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান গণহত্যা, ধর্ষণ ও জুলুম-নির্যাতন করেছে। এজন্য আমরা পাকিস্তানের নিন্দা করি। তবে পাকিস্তানে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগ এখনো কত শক্তিশালী, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ একটি উদাহারণ অপছন্দ হলেও বিরল দৃষ্টান্ত স্বরূপ আনতে হয়। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে দÐিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। নওয়াজ শরীফও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় মাথা পেতে নিয়ে বিদায় নিয়েছেন। আইনের শাসনের এক অনন্য নজির ও বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমাদের দেশে আইনের শাসনের বুলি আওড়িয়ে মুখে ফেনা তোলা হয়। অথচ সুপ্রিম কোর্টের রায় যদি সরকারের পছন্দ না হয়, তাহলে প্রধান বিচারপতিকে দেশত্যাগ ও পদত্যাগে করতে বাধ্য করা হয়। এ হচ্ছে আমার দেশের ন্যায় বিচার ও আইনের শাসনের নমুনা! আমাদের দেশ যেখানে নির্বাহী বিভাগ দ্বারা বিরোধী মত সব সরকারের আমলে নির্যাতিত হয়ে থাকে, গ্রেফতার, হামলা, মামলা, গুম ও খুন নিত্য নৈমত্তিক বিষয়। এখানে ‘বিচারের বাণী নিরবে কাঁদে’।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর দফায় দফায় বিচারপতিদের যে ভাষায় মন্ত্রী ও এমপিরা আক্রমণ করেছেন, তাতে বিচার বিভাগের প্রতি ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টিভঙ্গি দেশ ও জাতির কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। যে দেশের দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি, সরকারের রোষানলে পড়ে নিরুপায় হয়ে বিদেশে পাড়ি জমানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না, যে দেশের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সম্মান রক্ষার জন্য পদত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না, যে দেশে দু’দশক পুরানো দুই কোটি টাকার ভিত্তিহীন ঘষামাজা ও কৃত্রিম অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জেলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না, সেদেশে সুশাসন, আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার এসব উক্তি ব্যাঙের সর্দি, সোনার হরিণ ও আকাশ-কুসুম ভাবনা নয় কী?
জিয়া অরফেনাজ ট্রাস্ট মামলার রায় প্রসঙ্গে জাতীয় ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘প্রশ্ন ফাঁসের মত রায়ও ফাঁস ছিল। তবে তিন বছর না পাচঁ বছর তা ছিল আলোচনায়’। এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল অলি আহমদ বীর বিক্রম প্রশ্ন তুলেছেন, ৬৩২ পৃষ্ঠার রায় কীভাবে মাত্র দশ দিনে লেখা সম্ভব? তিনি বলেন, রায় পূর্বপরিকল্পিত ও সাজানো। যে দেশে শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে দুই কোটি টাকার কাল্পনিক অভিযোগে একটি বৃহত্তম দলের প্রধানকে পাঁচ বছরের জেল দেয়া রহস্যজনক! এটি একদলীয় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। রায়ে সরকারের হাত নেই, ক্ষমতাসীনদের এমন গর্জন তর্জনই প্রমাণ করে, ‘ঠাকুর ঘরে কে আমি কলা খায় না’।
বিচারাধীন বিষয়ে আগাম মন্তব্য ও বক্তব্য দেয়া আদালত অবমাননার শামিল। অথচ রায়ের আগে মন্ত্রী ও এমপিরা আগাম বক্তব্য দিলেও তা আদালত অবমাননা হয় না! উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল করলেও তা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে না! রায় পক্ষে না গেলে বিচারপতিকে রাজাকার বলে গালি দিলেও তা আদালত অবমাননার শামিল হয় না! অন্যদিকে নি¤œ আদালতের রায়ের সমালোচনা করলেই নাকি আদালত অবমাননা হয়ে যায়! এ এক আজব দেশ ও অবাক বিচারব্যবস্থা! যেদেশে আদালত অবমাননার ফরমান গলায় ঝুলিয়ে স্বদর্পে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা যায়, যে দেশে উচ্চ আদালতে দুর্নীতির দায়ে দন্ডিত হলেও মন্ত্রিত্ব যায় না, জেলে যেতে হয় না, সেদেশেই আবার জোর গলায় বলাহ য় ‘আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়’। একি জাতিকে বোকা বানানো আর জনগণের সাথে তামাশা নয় কী? একদিকে সরকারের নির্বাহী আদেশে ক্ষমতাসীনদের হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহর হয়। অন্যদিকে দ্বিমতপোষণকারী, ভিন্নমতাবলম্বী আর বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার প্রতিযোগিতা হয়। আবার বলা হয় ‘আইনের চোখে সবাই সমান’। এ কেমন আইনের শাসন? এ ডাবল স্ট্যান্ডার্ড থেকে জাতি কবে মুক্তি পাবে?
দোষারূপ, কাঁদাছুড়াছুড়ি, অশ্রদ্ধা, অবিশ্বাস আর প্রতিহিংসা থেকে কী বাংলাদেশের রাজনীতি বের হয়ে আসতে পারবে না? রাষ্ট্র নামক কাঠামোটি তিনটি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। আইন, বিচার ও নির্বাহী পিলার। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের এ তিনটি অঙ্গের সমন্নয় করা এবং বিভাগ তিনটিকে স্বাধীনভাবে চলতে সহযোগিতা করা। তাহলেই কেবল মানবাধিকার, ন্যায়বিচার আর সুশাসন জাতিকে উপহার দেয়া সম্ভব। সরকার যদি একে একে ভিত্তির সব পিলার নিজের কব্জায় নিয়ে গুলিয়ে ও গুড়িয়ে ফেলে, তাহলে রাষ্ট্র নামক কাঠামোটি কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? তখন রাষ্ট্রে গণতন্ত্র, সুসাশন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্টান গেøাবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি এক রিপোর্টে জানিয়েছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ সাড়ে পাচঁ হাজার কোটি টাকা। এসব তথ্য কী প্রমাণ করে? দেশে দুর্নীতি হয় না? রিজার্ভ চুরি, বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক কেলেঙ্কারীর রাঘব বোয়ালরা দাপটের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর দুর্নীতির কৃত্রিম অভিযোগে নিরাপরাধ আবার কেউ কারাভোগ করছেন! এ কেমন ন্যায় বিচার? এ কেমন আইনের শাসন? এ কেমন সুশাসন? মনগড়া বাছাই করা বিচার দিয়ে, সুশাসন বা সুবিচার কোনোটিই কায়েম করা যায় না।
জনগণের শেষ আশ্রয় স্থল হচ্ছে আদালত। সেই আদালতকে যদি এভাবে মেরুদন্ডহীন ও ধ্বংস করা হয়, তাহলে দেশ মগের মুল্লুকে পরিণত হওয়ার আর বাকীই বা থাকে কী? হাজার কোটি টাকা রিজার্ভ চুরির পরও দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না। আর দুই দশক আগের দুই কোটি টাকার মিথ্যা অভিযোগ, যা রাষ্ট্র বা জনগণের টাকা নয় একান্ত ব্যক্তিগত ফান্ডের টাকা, যা ব্যক্তিগত অনুদান ব্যক্তিগত ফান্ডে দেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও বাড়াবাড়ি অনাধিকার চর্চা নয় কী? ব্যক্তিগত অনুদান যা এখনো ব্যাংকে জমা আছে, যার একটি টাকাও খরচ হয়নি বরং সুদাসলে বেড়ে আরো তিনগুণ হয়েছে। যেখানে কোনো নীতিই গ্রহণ করা হয়নি, সেখানে দুর্নীতি হয় কী করে? যেখানে তছরুপই হয়নি, সেখানে দুর্নীতির প্রশ্ন তোলা অবান্তর ও হাস্যকর নয় কী?
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট একটি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি ট্রাস্ট পরিচালিত হয় নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। দায়িত্বপ্রাপ্তগণ ভালো মনে করলে ট্রাস্টের টাকা ব্যাংকে এফডিআর করতে পারেন। তাতে দোষের কী আছে? টাকা গুলোতো নয়ছয় হয়নি? দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ ট্রাস্টের টাকা এফডিআর করার অজুহাতে এর সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন নিরীহ ব্যক্তিকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে বিচারের মুখোমুখী দাঁড় করানো প্রতিহিংসা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় কী? সাবেক প্রধানমন্ত্রী বয়সের ভারে ন্যূজ, ৭৩ বছরের একজন বৃদ্ধা। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, বিধ্বস্ত বয়স্ক একজন নারী। স্বামী হারা একজন বিধ্ববা, সন্তান হারা একজন ব্যথিত মা, শারীরিকভাবে অসুস্থ একজন মহিলা। যিনি সহযোগী ছাড়া একা চলতে পারেন না। আদালতের দোহাই দিয়ে তার সারা জীবনের সুখ, দুঃখ ও হাসি-কান্নার স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটিও গ্রাস করা হয়েছে। তার প্রতি এমন আচরণ কী স্বাভাবিক বলে মনে করা যায়?
দেশ ও জাতির কাছে সবিনয়ে আজ জানতে ইচ্ছা করে, দেশ, মাটি ও মানুষকে ভালবাসা কী অপরাধ? দেশ ও জাতির কল্যাণে রাজনীতি করা কী দোষণীয়? সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা কী অন্যায়? একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা! দেশ ও জাতিকে কী ম্যাসেজ দেয়? ডিভিশন ও সার্টিফাইড কপি দিতে গড়িমেসি! শ্যোন এ্যারেস্ট নিয়ে বিভ্রান্তী, ধূম্রজাল ও লোকচুরি খেলা কী প্রমাণ করে? মিথ্যা মামলায় হয়রানি, গ্রেফতার ও দÐ এখন সাধারণ ঘটনা। মিথ্যা, অনিয়ম ও অন্যায়কে আজ সত্য, নিয়ম ও ন্যায়ে রূপান্তরের প্রচেষ্টা চলছে। এভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রচেষ্টা কতটুকু সফল হবে সময়ই বলে দেবে।
লেখক: সৌদী আরব প্রবাসী, গ্রন্থকার ও গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
গনতন্ত্র ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ২:১৬ এএম says : 5
কখন দিবে গোড়ায় পানি, গাছের পাতাগুলি যাচ্ছে একটি একটি করে যে ঝরে,এখন থেকে গাছের যত্ন না নিলে, গাছটা হয়ত:বা যাবে মরে ।
Total Reply(0)
জাকির রহমান সিকদার ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:১৯ পিএম says : 0
এই দেশ এখন মগের মুল্লুকে পরিনত হয়েছে,একথা বলতে আর দ্বিধা হয়না....
Total Reply(0)
Faruk Mirdha ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:১৯ পিএম says : 1
জি ভাই একমত
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন