বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মো: আবদুল হামিদ এবং ভারতের অন্যতম ক্ষুদ্র রাজ্য আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়ালের মর্যাদা কি সমান? মোটেই নয়। অথচ তাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনটাই ছিল স্বীকৃত কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও প্রথার খেলাপ। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট তার ভারত সফরকালে দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক ও আলোচনা করবেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট বা সরকারের প্রধান নির্বাহক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। এ ধরনের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে ভারতের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী চাইলে সে দেশের কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও উপস্থিত থাকতে পারেন। এর বাইরে কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতও করতে পারেন। এটাই নিয়ম। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটানো হয়েছে প্রেসিডেন্ট মো: আবদুল হামিদের আসাম সফরকালে। ‘এ্যাডভান্টেজ আসাম’, শীর্ষক এক বিশ্ব বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগদানের জন্য প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ আসাম যান ৮ মার্চ। বিমান বন্দরে তাকে স্বাগত জানান আসামের গর্ভনর জগদীশ মুখী। তাকে রাখা হয় পাঁচতারকা হোটেল ভিয়াস্তায়। ওই হোটেলেই তার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি নিয়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়ালের বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে আসামের মুখ্যমন্ত্রীর পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। শুধু তাই নয়, ওই বৈঠকের ভেন্যুতে আগেই পৌঁছে যান প্রেসিডেন্ট মো: আবদুল হামিদ। সেখানে তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়ালের জন্য। ১০ মিনিট পর তিনি আসেন এবং যথারীতি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে এখন সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সম্পর্কিত দুটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মঞ্চে প্রেসিডেন্ট মো: আবদুল হামিদ তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আসামের মুখ্যমন্ত্রীর জন্য সংরক্ষিত আসনটি খালি পড়ে আছে। পরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট মো: আবদুল হামিদ মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়ালের সঙ্গে করমর্দন করছেন। এই আয়োজন এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রীর বিলম্বে বৈঠকস্থলে আসার মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলক ও পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে বিব্রত, অবমূল্যায়ন ও অপমান করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। তিনি এক নম্বর নাগরিক। তিনি রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে গণ্য। তার বিব্রত হওয়া, অবমূল্যায়নের শিকার হওয়া কিংবা অপমানিত হওয়ার অর্থ, জাতি বিব্রত হয়েছে, অবমূল্যায়িত হয়েছে, অপমানিত হয়েছে। বৈঠকের ব্যাপারে বাংলাদেশের ভূমিকা ও অবস্থান কী ছিল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, ওই বৈঠকের আয়োজনে সম্মতি দেয়াই ঠিক হয়নি। দ্বিতীয়ত: প্রেসিডেন্টের উচিৎ ছিল, তার ও দেশের মর্যাদার স্বার্থে তাৎক্ষণিকভাবে বৈঠক বাতিল ঘোষণা করে ফিরে আসা। তিনি তার কিছুই করেননি। যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ দু:খ ও ক্ষোভের সঙ্গে প্রশ্ন করেছেন, বন্ধুত্বের নির্দশন রাখতে গিয়ে ভারতের তাঁবেদারি করে নিজেদের আর কত নীচে নামাতে হবে?
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া একটি দেশ। বিশ্বে এমন জাতি খুব বেশি নেই, যারা যুদ্ধ করে স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব ও অহংকার। এই যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা, স্বাধীনতার গর্ব ও অহংকার কোনো কারণে ক্ষুণœ হোক, খর্বিত হোক জাতি কোনোভাবেই তা মেনে নিতে পারেনা। ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল, যুদ্ধে সার্বিক সহযোগিতা করেছিল। সেজন্য আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু সেই কৃতজ্ঞতা স্বীকারের অর্থ এটা হতে পারেনা যে, আমরা তার কাছে নতজানু হয়ে থাকবো, তার ইচ্ছার দাসে পরিণত হয়ে থাকবো। এটা জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদার খেলাপ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী। অত্যন্ত দু:খজনক হলেও আমরা শুরু থেকেই লক্ষ্য করে আসছি, ভারত আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে, জাতীয় মর্যাদাকে যথাযথ মূল্য দেয়না। সার্বভৌম সমতার নীতি অনুযায়ী আচরণ করেনা। ভারতীয়দের একাংশের ধারণা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের দান। ভারতের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পরিকরের ‘ভারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা উপহার হিসাবে দিয়েছে’, ধরনের মন্তব্যে তাদের সেই ধারণারই প্রতিফলন রয়েছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের জাতীয় মর্যাদার অবমূল্যায়ণ করতে, আমাদের নেতাদের অপমান ও হেয়প্রতিপন্ন করতে ভারত কিছুমাত্র দ্বিধা করেনা। আসামের মুখ্যমন্ত্রী যথাসময়ে বৈঠকস্থলে উপস্থিত না হয়ে ‘দাদাগিরির’ প্রমাণ রেখেছেন এবং প্রেসিডেন্ট মো: আবদুল হামিদকে অসম্মানিত করেছেন। শুধু তাই নয়, বিগত ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্টে মো: আবদুল হামিদের পাঁচদিনের ভারত সফরকালেও তার প্রতি যথোচিত মর্যাদা ও সৌজন্য প্রদর্শন করা হয়নি। ওই সফরে তিনি আগ্রা, জয়পুর, আজমীর, কোলকাতা ও শান্তি নিকেতনে যান। আগ্রায় তাকে একটি নি¤œমানের হোটেলে রাখা হয়। তাকে তাজমহল দেখাতে ব্যাটারি চালিত একটি সাধারণ পরিবহন ব্যবহার করা হয়। আজমীর শরীফে তাকে সাধারণ দশনার্থীর বাইরে কোনো মর্যাদা দেয়া হয়না। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার উপস্থিতিতে কোলকাতায় এক অনুষ্ঠানে ‘মুখ্যমন্ত্রী’ হিসাবে সম্বোধন করা হয়। তখন এ নিয়ে বাংলাদেশে তুমুল সমালোচনা হয়।
প্রশ্ন ওঠে, ভারতের এবং ভারতীয়দের এ ধরনের আচরণের কারণ কি? প্রথম কারণ ভারতের জাতীয় মানস ও নাগরিক মানসের মধ্যে নিহিত। এই যুগ্মমানস বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় মর্যাদাকে তুলমূল্যে স্বীকার করতে চায় না। এই যুগ্মমানস বাংলাদেশকে ভারতের তাঁবেদার দেশ হিসাবে দেখতে চায়। দ্বিতীয় কারণ, আমাদের কিছু দল, নেতা ও বুদ্ধিজীবির দাস্যমনোবৃত্তি। তারা ভারতের বশংবদ ও দাসাসুদাস হয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। এই মনোবৃত্তির প্রকাশ ও প্রমাণের কোনো অভাব নেই। গত জানুয়ারীতে ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং কয়েকদিন অবস্থান করেন। ওই সময় তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হয়। কোনো দেশের প্রেসিডেন্টকে যেভাবে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল দেয়া হয়, ভারতের ওই সাবেক প্রেসিডেন্টকেও সেরূপ প্রটোকলই দেয়া হয়। ওই সময় যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি প্রকাশিত হয় যাতে দেখা যায়, প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে ফটোসেশনে শামিল হয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ, স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রমুখ। দেখা যায়, প্রণব মুখার্জী একটি চেয়ারে বসে আছেন এবং তারা পেছনে সারবেধে দাঁড়িয়ে আছেন। এইচ এম এরশাদ ও আবুল মাল আবদুল মুহিত বয়সে প্রণব মুখার্জীর চেয়ে বড় হলেও তারা চেয়ারে বসার সুযোগ পাননি এবং না পেয়েও যেন তারা খুশী। এটা কি দাস্যমনোবৃত্তির প্রমাণ বহণ করেনা? আমরা যতদিন নিজেদের ও জাতির মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন না হবো, ততদিন আমাদের এ ধরনের অপমানজনক আচরণের শিকার হতে হবে। শুধু সচেতন হলেই চলবে না, আত্মমর্যাদা ও জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখাসহ স্বাধীন জাতিসত্তার শ্লাঘাবোধকেও সদা জাগ্রত রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন