\ দুই \
ফকীহগণ বলেন, যে নারীর গর্ভ থেকে মানুষ জন্মলাভ করে তিনি সেই মানুষের প্রকৃত মাতা। আর যে নারীর সন্তান কাউকে জন্ম দেয় সেই নারীও রূপকার্থে তার মাতা। পিতার মা হলে তিনি দাদী এবং মায়ের মা হলে তিনি নানী। যে মহিলা কোন শিশুকে দুধ পান করান, অথচ তাকে গর্ভে ধারণা করেননি, তিনি তার দুধমাতা। “আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, পৃ.৮৪” পবিত্র কুরআনে এ শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: আর আমি মূসা-এর মায়ের প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম যে, তাকে দুধ পান করাতে থাক। “অল-কুরআন, ২৮:০৭”
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: তোমাদের মধ্যে যারা তাদের স্ত্রীগণকে মাতা বলে ফেলে, তাদের স্ত্রীগণ তাদের মাতা নয়। তাদের মাতা কেবল তারাই যারা তাদেরকে জন্মদান করেছেন। তারা তো অসমীচীন ও ভিত্তিহীন কথাই বলে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মার্জনাকারী ও ক্ষমাশীল। “আল-কুরআন, ৫৮:০২”। আরবীতে জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীকে যাথাক্রমে ওয়ালিদ ও ওয়ালিদাহ বলা হয়। অতএব পিতা-মাতার সংজ্ঞা ক্ষেত্রে এ আইন ও ফকীহগণের মতামতের মধ্যে পার্থক্য নেই। ‘ভরণ-পোষণ’ শব্দটির আরবী প্রতিশব্দ হলো নাফাকাতুন। এর অর্থ হলো খরচ, ব্যয়, জীবন নির্বাহের ব্যয়, খোরপোষ। পরিভাষায়, ‘নাফাকাহ’ বা খোরপোষ হলো অপচয় ছাড়া যার ওপর ভিত্তি করে মানুষ জীবনধারাণ করে। “আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.২, পৃ,১০৩”। অর্থাৎ যা জীবন ধারণের ভিত্তি। সুতরাং জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদাসমূহ তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? বল, ‘তোমার যে সম্পদ ব্যয় করবে, তা পিতা-মাতা, আত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য। আর যে কোন ভাল কাজ তোমরা কর, নিশ্চয় সে ব্যাপারে আল্লাহ সুপরিজ্ঞাত। “আল-কুরআন ০২:২১৫”। ‘নাফাকাতুন’ পরিভাষাটির সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি পরিভাষা হলো ‘আল-‘আতা’ অর্থাৎ বৃত্তি, অনুদান। রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান হতদারদের জন্য বায়তুলমাল থেকে যা নির্ধারণ করেন তাকে আল-‘আতা বা বৃত্তি বলা হয়। ‘নাফাকাহ’ ও ‘আতা’- এর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ‘নাফকাহ’ শরী‘আহ কর্তৃক র্ধায হয়, আর ‘বৃত্তি’ রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান কর্তৃক ধার্য হয়। “আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.২, পৃ.১০৪”। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: বিত্তবান নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবনোপকরণ সীমিত, সে আল্লাহ তাকেযা দান করেছেন তা হতে দান করবে। “আল-কুরআন, ৬৫:০৭”। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: পিতার কর্তব্য যথাবিধি তাদের ভরণ-পোষণ করা। “আল-কুরআন, ০২:২৩৩”। আইনের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে কোন পিতা-মাতার একাধিক সন্তান থাকলে তারা আলোচনার মাধ্যমে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিশ্চিত করবেন এবং তা নিশ্চিত করার জন্য সন্তানদেরকে তাদের পিতা-মাতার সাথে একসঙ্গে এবং একস্থানে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে। “পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩, ধারা-৩”। আইনের ৩নং ধারার (৪) এ বলা হয়েছে, পিতা-মাতাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃদ্ধ নিবাসে বসবাস করতে বাধ্য করা যাবে না কিংবা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করা যাবে না। ধারা ৩ (৪) নং উপধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তান তাঁর পিতা-মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করবে। ৩নং ধারার (৬)নং উপধারায় বলা হয়েছে, পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে সন্তান থেকে পৃথক বসবাস করলে সেক্ষেত্রে তাদের সাথে নিয়মিত সাক্ষাৎ করতে হবে। আইনের ৩নং ধারা এর (৭) নং উপধারায় বলা হয়েছে যে, পিতা-মাতা সন্তানদের সাথে বসবাস না করে পৃথকভাবে বসবাস করলে সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তান তার মাসিক বা বাৎসরিক আয় হতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা বা ক্ষেত্রে হিসেবে উভয়কে নিয়মিতভাবে প্রদান করবে। উল্লিখিত আইনের ৩ নং ধারায় ১ থেকে ৭ পর্যন্ত মোট সাতটি উপধারায় ভরণ-পোষণের বিস্তারিত দিক নির্দেশনা ও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। যথা পিতা-মাতা ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করা, একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তা নির্ধারণ করা, বৃদ্ধ নিবাসে বসবাসে বাধ্য না করা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করা এবং মাসিক আয় থেকে অর্থ প্রদান করা। ৩নং উপধারায় পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চত করার জন্য সন্তানকে পিতা-মাতার সাথে একইসঙ্গে একইস্থানে বসবাস নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙ্গে একক পরিবার প্রথা গড়ে ওঠছে। কর্মসংস্থানের তাগিদে গ্রাম অঞ্চল থেকে মানুষ শহরমুখী হয়ে পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে এ দিক নির্দেশনা অনুপস্থিত। এছাড়া কর্মজীবী সন্তানদের তাদের পিতা-মাতার সাথে একই স্থানে বসবাস করার বিধান বাধ্যতামূলক করা হলে তা নতুন জটিলতা তৈরি করবে। উপেক্ষা নয়; সম্মান ও সহানুভূতি বজায় রেখে পিতা-মাতাকে তাদের পছন্দনীয় আবাসস্থলেই রাখা বেশি কল্যাণজনক হবে। ৭নং উপধারায় বলা হয়েছে, পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে সন্তানের সাথে বসবাস না করে পৃথকভাবে বসবাস করলে সে ক্ষেত্রে সন্তান তার দৈনন্দিন আয় রোজগার বা মাসিক আয় বা বার্ষিক আয় থেকে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা-মাতাকে প্রদান করবে। এ ধারায় ‘যুক্তিসঙ্গত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে; কিন্তু এর সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। ২নং ধারায় ‘ভরণ-পোষণ’ বলতে খাওয়-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধার কথা বলা হয়েছে। ৭নং উপধারায় বর্ণিত ‘যুক্তিসঙ্গত’ অর্থ দ্বারা ২নং ধরার ‘ভরণ-পোষণ’ সম্পন্ন হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ দ্বারা ভরণ-পোষণ সম্ভব না হলে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে অথবা সন্তানের আয় দ্বারা তার নিজেরই খরচ সংকুলান না হলে অথবা সন্তান নিজেই যদি পিতা-মাতার উপর বোঝা হয়ে থাকেন তাহলে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, এর দিকনির্দেশনা স্পষ্ট করা হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন