শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বিদেশী ক‚টনীতিকদের আপত্তি ও উদ্বেগ

| প্রকাশের সময় : ২৭ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে আপত্তি ও উদ্বেগ জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ১০টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও তাদের প্রতিনিধিরা। গত রোববার সচিবালয়ে তারা আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই আপত্তি ও উদ্বেগের কথা জানান। ধারগুলো হলো : ২১,২৫,২৮ ও ৩২। আইনমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর জার্মানির রাষ্ট্রদূত টমাস প্রিনজ সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া তৈরি করেছে, তাদের পক্ষ থেকে, সেই আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে যেসব ধারা, সেগুলো নিয়েই তারা কথা বলেছেন। আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি তাদের বক্তব্য শুনেছেন এবং তার পক্ষ থেকেও বক্তব্য দেয়া হয়েছে। সরকার তাদের বক্তব্য দেখবে ও বিবেচনা করবে। গত ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রীসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদিত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন মহলে উল্লিখিত ধারাগুলো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। আপত্তি ও উদ্বেগ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ধারাগুলো সংশোধন বা সম্পূর্ণ বাতিল করার দাবী জানানো হয়। এর প্রেক্ষিতে সরকারের তরফে আশ্বাস দেয়া হয় যে, আলোচনা-পর্যালোচনা করে যদি প্রয়োজন হয় তবে আপত্তিকৃত ধারাগুলো পরিবর্তন, সংশোধন অথবা স্পষ্ট করা হবে। এতদিনেও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এমতাবস্থায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, সুইডেন, স্পেন, ডেনমার্ক, নরওয়েও সুইজারল্যাÐের কূটনৈতিকগণ তাদের প্রতিক্রিয়া জানালেন। দেশী-বিদেশী সর্বমহলই একমত যে, প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিশেষ করে আইনের ওই ধারাগুলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার সংকুচিত করবে। গভীর উদ্বেগের বিষয় এই যে, বহুল সমালোচিত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অত্যন্ত কৌশলে সংযোজন করা হয়েছে।
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাস এমন কিছু প্রকাশ করেন যা মিথ্যা, অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃংখলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয় তাহলে তার কাজ হবে একটি অপরাধ। এবং এই ধারার অধীনে কেউ অপরাধ কবলে তিনি অনধিক ১৪ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদÐে ও অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদÐে দÐিত হবেন। ধারাটি অস্পষ্ট এবং একে ইচ্ছেমত ব্যাখ্যার করার সুযোগ রয়েছে। একারণে এর ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। মামলা ও গ্রেফতারের ক্ষেত্রে আইনশৃংখলাবাহিনীর লোকদের একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রধান করায় ওই অপব্যবহার সংঘটিত হয়েছে। আইসিটি আইনে এ পর্যন্ত দেড় হাজারের মতো মামলা হয়েছে। এসব মামলার ৬৫ শতংশই হয়েছে ৫৭ ধারায়। এ ধারায় দায়েরকৃত কিছু মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। কয়েকটিতে আসামীরা শাস্তি পেয়েছে, কয়েকটিতে খালাস পেয়েছে। বাকী মামলাগুলো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে আছে। ইতোমধ্যে ধারাটি এই আইন থেকে বাদ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অথচ মামলাগুলো রেখে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, মামলাগুলোর বিচার ওই ধারা অনুযায়ীই চলবে। এই কুখ্যাত ধারাটিই যখন আরো আটঘাট বেধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংযোজন করা হয় তখন সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে পারা যায় না। এই আইনের ২১, ২৫ ও ২৮ ধারার বিষয়বস্তু ও শাস্তির বিধান থেকেই বুঝা যায়, ধারাগুলোর প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করে না। এ ধারনের একটি আইন বাস্তব কারণেই থাকা আবশ্যক। কিন্তু সেই আবশ্যকতার সূত্র ধরে এমন ধারা এতে সংযোজন করা উচিৎ নয়, যাতে এর অপব্যবহারের সুযোগ থাকবে এবং মানুষ জুলুম ও হয়রানির শিকার হবে। এই আইনের ৩২ ধারাটি অত্যন্ত মারাত্মক। এই ধারাটি কম্পিউটার গুপ্তচরবৃত্তি সংক্রান্ত, যাতে বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনী প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্ত¡শাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার কোনো ধরনের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ, সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তির ওই কাজ হবে কম্পিউটার গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ। বলা নিষ্প্রয়োজন, এ ধারার কারণে মত প্রকাশের অধিকার ও স্বাধীনতা ক্ষুণœ হবে। সাংবাদিকরা অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে গুপ্তচারবৃত্তির অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার আশংকার মধ্যে থাকবেন। অন্যায়, অপরাধ ও দুর্নীতির ওপর প্রতিবেদন তৈরি বাধাগ্রস্ত হবে।
আইনের লক্ষ্য শৃংখলা বিধান, অপরাধ দমন ও তার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে, গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থে কোনো আইন হতে পারে না। এর মধ্যেই অনেকে এই আইনকে নির্যাতনমূলক, বিরোধী দল ও মত দমন এবং মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বকারী ‘কালো আইন’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। এর পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধন দাবী করেছেন। সম্পাদক পরিষদ আইনটির ব্যাপারে অংশীজনদের সংশ্লিষ্ট করার আহŸান জানিয়েছেন। জন-অহিত হতে পারে, বা তার আশংকা থাকতে পারে এমন আইন হতে পারে না। দেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে, এটা যেমন সুখবর তেমনি ‘স্বৈরতন্ত্রী’ দেশ হওয়ার কুখ্যাতিও অত্যন্ত লজ্জাজনক। জনগণের অধিকার ও মানবাধিকার খর্ব করে দেশকে বিশ্বের কাছে সম্মান ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। বিদেশী কূটনীতিকরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে যে আপত্তি ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তাদের মতামতকে উপেক্ষা করা সদ্বিবেচনার পরিচায়ক হবে না। দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ও স্বার্থের কথা, বিশ্বব্যাপী তাদের প্রভাবের কথাও আমলে রাখতে হবে। পরিশেষে আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আপত্তিকৃত ধারাগুলো বাতিল বা সংশোধন করার আহŸান জানাই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন