দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিনিয়োগ স্থবিরতা বিরাজ করছে। বেশকিছু বিনিয়োগ বান্ধব নীতিমালা গ্রহণের পরও কাঙ্খিত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হয়নি। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান ও জীবনমান উন্নয়নে নতুন নতুন বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই। বিনিয়োগ না হলে রফতানী বাণিজ্যে কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জন অসম্ভব। বাণিজ্য ঘাটতি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও রেমিটেন্স প্রবাহ শ্লথ হয়ে পড়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমান অর্থ পাচারের কারণে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নজিরবিহন অর্থ সংকটে পড়েছে। বিনিয়োগে মন্দার কারণগুলো সবারই জানা। দেশি-বিদেশী নানা সংস্থার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে অনেক তথ্য-উপাত্ত এবং সুপারিশমালা পাওয়া গেলেও সে সব সুপারিশমালার আলোকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহনে ব্যর্থ হয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় ও সংস্থাগুলো। বিশেষত দেশে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, অর্থ পাচারের ফাঁক-ফোঁকড়গুলো বন্ধ না করে যতই বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ করা হোক, আদতে তা কোন কাজে আসেনা। চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতাই তার প্রমান। দুর্নীতি দমন ও কথিত জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধের নামে দুদক, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো যে সব উদ্যোগ নিয়েছে তা বিনিয়োগে আস্থা ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার বদলে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারিদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে।
অর্থপাচার ও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের উপর নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে দেশে জমি ও ফ্লাট ক্রয়-বিক্রয়ের উপর বাড়তি নজরদারির ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে সরকার। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও মানদন্ড নির্ধারণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রæপের(এপিজি) সুপারিশ অনুসারে মান্ডি লন্ডারিং ও ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক লেনদেন প্রতিরোধে জাতীয় ঝুঁকি নিরূপণ প্রতিবেদন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে ইতিপূর্বে প্রণীত ও গৃহিত এ সংক্রান্ত ১৩৮টি সুপারিশের মধ্যে অধিকাংশই এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি বলে জানা যায়। সে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ না করে সরকার এবার দেশে জমি ও ফ্লাট ক্রয়-বিক্রয়ে বিশেষ নজরদারি আরোপ করতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, তৈরী পোশাক খাতের পর আবাসন খাতেই বেশী বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে এ খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিরাজমান অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুত সংযোগ পেতে সমস্যার কারণে এ খাতের বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটছেনা। এহেন বাস্তবতায় জমি ও ফ্লাট ক্রয়-বিক্রয়ের উপর নতুন শর্ত ও বাড়তি নজরদারি এ খাতকে নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশংকা করছেন। মানি লন্ডারিং ঠেকাতে বিদেশে দেশের স্থাবর সম্পদের ক্রয়-বিক্রয় লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রাহক পরিচিতি বা কেওয়াইসি নীতিমালা প্রণয়ণের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। তবে নজরদারির নামে আবাসন খাতের বিনিয়োগে অহেতুক ভীতি ও প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয় এরূপ যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। মানি লন্ডারিং বন্ধে আমদানী-রফতানী খাতে জালিয়াতি ভ’য়া ইনভয়েসিং বন্ধ করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
স্বল্পন্নোত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার প্রাথমিক মান অর্জনের পর অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি পুরনো প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা এখন সরকারের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতিশীলতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবী। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি এবং ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সংকট গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নামতে বাধ্য। অস্বাভাবিক বাণিজ্য ঘাটতির পেছনে ব্যাপক অর্থ পাচারের যোগসুত্র থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষত: নির্বাচনের বছর হওয়ায় টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান। বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর ২০১৪ সালে দেশ থেকে সর্বোচ্চ পরিমান, প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছিল বলে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে জানা যায়। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ও বাড়াতে বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। এ ক্ষেত্রে দুদক, এনবিআর বা আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। নজরদারির নামে সম্ভাবনাময় খাতে ভীতি সঞ্চার করলে টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যেতে বাধ্য। বিভিন্ন গবেষনা সংস্থার তরফ থেকে প্রকাশিত সুপারিশমালায় দেশে বিনিয়োগ স্থবিরতার জন্য দুর্নীতি, ভৌত অবকাঠামো খাতের দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্বলতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা-অনিশ্চয়তা, সুশাসনের অভাব ও নিরাপত্তাহীনতাকেই দায়ী করা করা হয়েছে। জননিরাপত্তা, আইনের শাসন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমেই কেবল বিনিয়োগবান্ধব ও আস্থাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। বিনিয়োগ বাড়াতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রয়োজন আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির যথাযথ উদ্যোগ নেয়া। নজরদারির নামে এমন কিছু করা মোটেই উচিত হবেনা, যাতে আস্থাহীনতা ও নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে যায়। সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনীতির সকল স্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার দিকে এখন নজর দেয়া জরুরী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন