একজন মানুষ ভালো কি মন্দ, সৎ না অসৎ, ভদ্র না অভদ্র, সুশীল না কুশীল বিবেচনা করা হয়, তার শিক্ষা, আচার-আচারণ, ব্যবহার, কথাবার্তা, চালচলন দেখে। এমন কি সঙ্গী-সাথী দেখেও মানুষকে বিচার করা যায়। মানুষের পেশাও ব্যক্তির চরিত্রকে প্রভাবিত করে। চরিত্রগঠনে সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান হলো বংশগতি ও পরিবেশ। বংশের প্রভাব মানব চরিত্র গঠনে শক্তিশালী উপাদান হিসাবে কাজ করে। একজন ভালো বংশের, ভালো মানুষের সন্তান ভালো হবার কথা। বাংলাদেশের সমাজে এ বিশ্বাসটি দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে। ভালো মানুষের সন্তানকে সকলে ভালোবাসে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। খারাপ মানুষের সন্তানকে সামনে না হলেও আড়ালে-আবডালে গালমন্দ করে, তাদের কাজের আলোচনা-সমালোচনা করে। সামাজিক নিন্দা ও কুৎসার হাত থেকে ভালো মানুষ ও তার সন্তানরা অনেকটা রেহাই পেলেও মন্দ মানুষের রক্ষা নাই। তার কর্মকান্ড ও আচার-আচরণ পাল্টিয়ে, অন্তত পাল্টানোর ভান করে সামাজিক নিন্দা ও ভর্ৎসনা থেকে রক্ষা পেতে হয়। পরিবেশ ব্যক্তি চরিত্র গঠনে আর একটি শক্তিশালী উপাদান। ভালো পরিবেশ ও ভালো মানুষ বা সমাজের সঙ্গ পেলে মানুষের চরিত্র পরিবর্তন হতে পারে। একজন চোর, ডাকাত, কালোবাজারী, দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে ভালো পরিবেশ ও সৎ সঙ্গে রাখতে পারলে তার চরিত্রে কিছুটা পরিবর্তন আসলেও আসতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা বংশগতি ও পরিবেশ উভয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তা শিক্ষা চরিত্র গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে শিক্ষা ও ভালো সঙ্গ মানুষকে অনেক সময় সৎ মহৎ, উদার, গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী হিসাবে তৈরি করতে সাহায্য করলেও তার ভিতরে লুকায়িত খারাপ গুণটি যেকোন সময় মাথাচাঁড়া দিয়ে উঠতে পারে। মুহূর্তে একজন মানুষ অমানুষে পরিণত হতে পারে। সমাজে এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। একজন দুর্নীতিবাজ ও চোরের ছেলে দেখা যায় সাধু সাজলেও প্রথম সুযোগেই বিরাট অপকর্ম করে বসেন। আবার একজন সাধুর ছেলে সঙ্গ দোষে ও অশিক্ষা, কুশিক্ষার প্রভাবে দাগী আসামী হতে পারে। আমার কথা হলো বংশ, পরিবেশ ও শিক্ষার প্রভাব ব্যক্তি জীবনে অস্বীকার করার উপায় নেই। এগুলো শক্তিশালী উপাদান হলেও ব্যক্তিকে নিজ প্রচেষ্টা, আগ্রহ ও সদিচ্ছাপ্রসূত কাজ করে নিজেকে তৈরি করতে হয়। ব্যক্তি স্বাধীন। এই স্বাধীনতা তাকে কর্মনির্ধারণ ও নিজেকে গড়ে তোলার ক্ষমতা দিয়েছে। ব্যক্তি তার স্বাধীন ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করে ভালো ও অসদ্ব্যবহার করে মন্দ উপাধি লাভ করতে পারে।
একইভাবে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্র গঠিত হয় তার কর্মকান্ড, বিশ^াস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিবেচনা করে। অধিকাংশ মানুষের আচার-আচরণ, ব্যবহার ও শিক্ষাদীক্ষা বিবেচনায় নিয়ে একটি সমাজকে ভালো বা উন্নত সমাজ বলা যায়। বাংলাদেশের সমাজ, পশ্চিমা সমাজ প্রভৃতি মূল্যায়ন করা হয় সমাজের অবস্থা, শিক্ষা, পরিবেশ, বিশ^াস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ প্রভৃতির আলোকে। রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে রাষ্ট্রের চরিত্র বর্ণনা করা যায়। কোনটি সমাজতান্ত্রিক, কোনটি গণতান্ত্রিক, কোনটি স্বৈরতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী, কোনটি রাজতান্ত্রিক প্রভৃতি। মানব চরিত্রের মতো রাষ্ট্রের চরিত্র তার কর্মকান্ড বিবেচনায় নিয়ে পাল্টে যায়। ইরানে রেজা শাহর পতনের পর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিচিতি পেয়েছে। সৌদি আরবে একবিংশ শতকে এসেও রাজতন্ত্র টিকে আছে। কতদিন টিকে থাকবে আল্লাহ জানেন। পরিবর্তনের কোন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, আরব বসন্তের প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে স্বৈরাচারী শাসনের পতন হলেও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হয়। বিগত কয়েক বছর ধরে সরকারের কর্মকান্ড গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্রকে বিতর্কিত করেছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন লেখায় বাংলাদেশ সরকারকে কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী বলা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। একপক্ষীয় নির্বাচন, বিরোধীদলের কর্মকান্ড বাধা দিয়ে সীমিত করা, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা, অত্যচার, নির্যাতন, গুম, খুন অব্যাহত রাখা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা না থাকা, সংসদে বিরোধীদল না থাকা, স্বঘোষিত অনির্বাচিত সংসদ ও সরকার চালু থাকা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কঠোর হস্তে দমনের নীলনকশা প্রণয়ন প্রভৃতি ও একদলীয় স্বার্থে অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ডের কারণে অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশকে কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিস্ট শাসনের অধীনস্থ মনে করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দারুণভাবে সীমিত করার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্বেগ জানিয়েছে। গত ২৫ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১০টি দেশের প্রতিনিধিরা সচিবালয়ে আইনমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের উদ্বেগ জানিয়েছেন। বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ইইউ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, ফ্রান্স, স্পেন, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। দুই ঘণ্টা বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা আলোচনা করেছি, তারা তাদের কথা বলেছেন, আমরা আমাদের কথা বলেছি। আমাদের আলোচনা আরো হবে, আরো কথা হবে। তারা বিশেষ করে ২১,২৫ ও ২৮ অনুচ্ছেদ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে জার্মানির রাষ্ট্রদূত ড. থমাস প্রিনজ বলেন ‘আমরা এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। আইনটি স্বাধীন মত প্রকাশের পথে অন্তরায় বলে আমরা মনে করি। বিশেষ করে এতে জামিন অযোগ্য ধারা রয়েছে। আইনটি অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। তিনি আরো বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১, ২৫, ২৮ ও ৩৫ ধারা জনগণের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে। এই আইনের শাস্তি, জামিন অযোগ্য ধারা এবং এই আইনের অপব্যবহার এই তিনটি বিষয় নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন’। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ, সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী সমাজের সদস্যরা তাদের উদ্বেগের কথা অনেকদিন থেকেই বলে আসছেন ও এই ধারাগুলো সংশোধন করার অনুরোধ জানাচ্ছেন। সরকার অবশ্য কারও কথায় কর্ণপাত করছে বলে মনে হয় না। সাংবাদিকদের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ’১৫ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধন করে ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ খসড়া অনুমোদন পায়। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (ক) ধারায় অনলাইনে মিথ্যা তথ্য, মান হানিকর ও সম্মান হানিকর সংবাদ প্রকাশ করলে জামিন অযোগ্য মামলায় ১৪/৭ বছর জেল ও ১ কোটি টাকা জরিমানার বিধান ছিল। ২০১৮ এর খসড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শাস্তি লঘু বা জামিনযোগ্য না করে আরও কঠোর করা হয়েছে।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে (১) মানিবক মর্যাদা (২) সামাজিক ন্যায় বিচার ও (৩) সাম্য তিনটি অধিকার স্বীকৃত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানবিক মর্যাদা, সাম্য, ন্যায়বিচার কোনটিই রক্ষা করা যাবে না। এই আইনে মামলায় একজন ব্যক্তিকে সহজেই বিপদে ফেলা যাবে। এনালগ সিস্টেমে প্রশাসনের নিকট থেকে তথ্য পাওয়া ও তথ্য আদান-প্রদানের অধিকার সকলের। এই আইনে মানুষের অধিকার সংকুচিত করে মত প্রকাশ ও তথ্য আদান প্রদানের অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। বিদেশীরা বাংলাদেশের আইনের কড়া সমালোচনা করছে ও উদ্বেগ জানাচ্ছে, এটি স্বাধীন দেশের সরকার ও নাগরিকদের জন্য লজ্জাকর। এ অবস্থার জন্য দায়ী প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনের অনুপস্থিতি। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়া একটি সুখবর বটে। তবে চূড়ান্তভাবে সুখবর পেতে আরও ছয় বছর অপেক্ষা করতে হবে। অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ কৃতিত্বের সাথে মোকাবেলা করতে পারলে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) তিনবছর পর ২০২১ সালে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসোক) নিকট সুপারিশ করবে। ইকোসোক চূড়ান্ত সুপারিশ করলে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি মিলবে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে অনেক আগেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেত। আওয়ামী লীগের নয় বছর শাসনকালে ৬ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। ২০১৭ সালেই পাচার হয়েছে ৭৭ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা পাচার হওয়া বিশে^ নজিরবিহীন ঘটনা। দেশপ্রেম বর্জিত ক্ষমতাবানরা কানাডায় বেগম পাড়া ও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ব্যাপক আকারের দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি আদায় করতো বলে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতো অনেকেই মনে করেন। এত দুর্নীতি ও লুটপাটের মহোৎসব স্বাধীনতার পর আর দেখা যায়নি। সুজন/সিপিডি ২০১৭ সালকে ব্যাংক লুটের বছর বলেছে। কর্মসংস্থান, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো, সামাজিক সুরক্ষা ও সুশাসন নিশ্চিতের সাথে শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হবে। দেশে কোন সেকটরে সুশাসন নাই। সাংবাদিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবী সমাজ থেকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেয়া হচ্ছে। জাকির হোসেন নামের এক একটি তরতাজা যুবককে পুলিশ চ্যাংদোলা করে সবার সামনে থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে তিনদিন তার পর লাশ ফেরত পাওয়া গেছে। বিএনপি মাহাসচিবকে ঝাপটে ধরে বাঁচার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা মিডিয়ায় কল্যাণে মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের হত্যা থামেনি, লুটপাট বন্ধ করা যায়নি, লেখাপড়ার মান সাংঘাতিকভাবে নিম্নগামী। প্রতিদিন গুম, খুন, ধর্ষণ, অবিরতভাবে চলছে। ঘরের ভিতর, পুকুরে, খাল বিল, নদী, নালায় লাশের মিছিল। সামাজিক সুরক্ষায় বালাই নাই, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী, ছেলে মা-বাবাকে খুন করছে, ভাই ভাইকে খুন করছে, এভাবে দেশ চলছে। ২০২৭ সন পর্যন্ত ইইউ শুল্কমুক্ত সুবিধা বজায় রাখলেও অন্যান্য দেশ ও দাতা সংস্থার কমসুদে ঋণ পাওয়ার সুবিধা সংকুচিত হবে। স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানোর ক্ষমতা কমে যাবে। মানব সম্পদ দক্ষতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষার মান বাড়ানো আবশ্যক, যা ইতোমধ্যে কমতে কমতে অনেক নিচে নেমে গেছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃংখলা লেগেই আছে। সুশাসন ও আইনের শাসন তিরোহিত। রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা প্রতিদিন ১০/১৫ জন মানুষের মৃত্যুকে অনিবার্য করে তুলেছে। রাজধানীর ভয়াবহ যানজটের চিত্র উন্নয়নশীল দেশের সার্টিফিকেট ¤øান করার জন্য যথেষ্ট।
যা বলছিলাম, এককজন মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিবেচনা করা হয় তার আচরণ, বিশ^াস ও কর্মকান্ড দিয়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আচরণ ও কর্মকান্ড বিবেচনা করে একটি জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২৩/০৩/১৮ তারিখে বাংলাদেশসহ ৫টি দেশকে স্বৈরতান্ত্রিক দেশ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। ‘বেরটলসম্যান স্টিফটুং’ নামে একটি জার্মান গবেষণা সংস্থা ২০১৫ এর ফেব্রæয়ারি থেকে ২০১৭ এর জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কাল ধরে গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করেছে। ১২৯ দেশের গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি ও সুশাসনের অবস্থা মূল্যায়ন করে প্রতিবেদনটি তৈরী করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না।’ ৫৮টি দেশে স্বৈরশাসন চলছে ও ৭১টি দেশ গণতান্ত্রিক। ১২৯টি দেশের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থা ৭০ নম্বরে। একই অবস্থানে রাশিয়া রয়েছে। পাঁচটি দেশের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাস্বিক, নিকারাগুয়া, ও উগান্ডা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব দেশে বহু বছর ধরে গণতন্ত্রকে ক্ষুণœ করা হচ্ছিল। ত্রæটিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য এটি ঘটেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যে বলা হয়েছে, সরকারের বিরাগভাজন হলে রক্ষা নাই। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট এর বৈশি^ক গণতন্ত্রের সূচকে ২০১৭ সালে ২০১৬ সালের তুলনায় ৮ ধাপ পিছিয়েছে। দেশটিতে হাইব্রিড শাসন চলছে, অবাধ নির্বাচন বাধা গ্রস্থ, বিরোধীদল ও গণমাধ্যম চাপে, আইনের শাসন ও নাগরিক সমাজ দুর্বল, দুর্নীতি ব্যাপক। এসব বলার পর রিপোটে সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান রয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ মানাধিকার লংঘনের চিত্র বিভিন্ন সময় প্রকাশ করে যাচ্ছে। মানবাধিকার বিষয়ক ‘সলিডারিটি গ্রুপ ফর বাংলাদেশ’ গণগ্রেফতারের সমালোচনা করে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেবার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। ফৌজদারী কোর্টকে স্বাধীনতা প্রদান, গুমকে ফৌজদারী অপরাধ হিসাবে গন্য করা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার উপর জোর দিয়েছে। সলিডারিটি বেশকটি মানবাধিকার সংস্থার সমন্বয়কারী গ্রুপ। বিবৃতিটির গুরুত্ব অনেক। স্বাধীনতার দিবসের আগমুহূর্তে ২২ মার্চ বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জানমাল, বাকস্বাধীনতা ও চলাচলের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার, ধরপাকড়, গুম, খুন সন্ত্রাস প্রভৃতি ঝুঁকির মুখে। সলিডারিটি গ্রুপ বাংলাদেশে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়, সরকারের সমালোচক ও অধিকার কর্মীদের দমন পীড়নে বাংলাদেশ মানবাধিকার ও স্বাধীনতা আক্রান্ত। সলিডারিটি গ্রুপ দেখিয়েছে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনে ১২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিরাপত্তা হেফাজতে পায়ে গুলি করায় বহু মানুষ বিকলাঙ্গ হয়েছে। এ সময় ৪২২ জন মানুষকে জোর করে গুম করা ও ১৪৮০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জড়িত বলে অভিযোগ আছে।
দেশ যেমন উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত হয়েছে, তেমনি দুর্নীতির মহাসড়কে চড়েছে। একই সময় জামান ভিত্তিক গবেষণা সংস্থাটি বাংলাদেশ সরকারের কর্মকান্ড ও বিরাজমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনীতির চালচিত্র পর্যবেক্ষণ করে এ দেশেকে স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মকান্ড এমনভাবে সংকুচিত করা হয়েছে যে, বিরোধীদল রাস্তায় নামতে পারছে না। সেতুমন্ত্রীর ঘরের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা পুলিশ বাহিনী অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। স্বৈরাচারী সরকারের লক্ষণ খুবই স্পষ্ট। বিচারবিভাগ পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রভাবাধীন এমন অভিযোগ আন্তর্জাতিক মহল থেকে করা হচ্ছে। স্বৈরশাসনের দেশের বিচার বিভাগ ক্ষতাসীনদের প্রভাবাধীন থাকে। ১০ দেশের ক‚টনীতিক দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা, জার্মান ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা, সলিডারিটি গ্রæপ ফর বাংলাদেশ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ববাদী শাসন দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করে যেসব বিবৃতি দিচ্ছে, তা বিবেচনায় নেয়া উচিত। তামাশার নির্বাচন গণতন্ত্রহীনতা, গুম, খুন, দুর্নীতি, দুঃশাসন ও কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গী বাংলাদেশকে ইমেজ সংকটে ফেলেছে। বিরোধীদল দমনে হাজার হাজার মামলা, লাখ লাখ আসামী, সভাসমাবেশ অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ, জোর করে গুম করা, বিচার বহির্ভূত হত্যা, সরকারের সমালোচক ও অধিকার কর্মীদের দমন পীড়ন প্রভৃতি কর্মকান্ডে বাংলাদেশে মানবাধিকার ও স্বাধীনতা আক্রান্ত, সংকুচিত। আর এতসব অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক কর্মকান্ডের মূলে রয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থার অভাব। তত্তাবধায়ক ব্যবস্থা তুলে দেয়ায় জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে নির্বাচনী ফলাফল তৈরি হচ্ছে। বিচারপতি খায়রুল হক সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনে ও জনদাবী ছাড়া একটি সুন্দর, সর্বগ্রহণযোগ্য ও বাংলাদেশের উপযোগী একটি বিধানকে বাতিল করায় দেশ মহাসংকটে নিপতিত। এমতাবস্থায় দেশের প্রয়োজনীয়তা, আবশ্যকতা, উপযোগিতা ও জনআকাংখার সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন ও সংশোধন হওয়া উচিত। দেশের ৯০% মানুষ যে পদ্ধতির সমর্থক, তা বাতিল হওয়ায় দেশ ও দেশের মানুষ মহাসংকটে পড়েছে। আরও দুটার্ম এই পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা থাকলেও পরবর্তীতে তাও রহিত করা হয়। ফলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন দারুণভাবে উত্তপ্ত হয়। রায় বাতিলের পর থেকে এখন পর্যন্ত শত শত লোকের মৃত্যু, আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ, কোটি কোটি টাকার সম্পদহানি এসবের দায় কে নেবে? সামনে নির্বাচন। দাতা গোষ্ঠি, সংস্থা ও দেশ থেকে উদ্বেগ জানানোর সাথে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিচ্ছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সদিচ্ছা নিয়ে সংলাপ আয়োজন করা জরুরি। আশা করা যায়, সংলাপের মধ্যে দিয়ে সমাধান বেরিয়ে আসবে। স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের স্বীকৃতি দেশ, জাতি ও সরকারের জন্য লজ্জাকর ও কলংকজনক।
লেখক: প্রফেসর (অব.) দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন