যে কোনো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে মসৃণ যোগাযোগ ব্যবস্থার ভূমিকা ও গুরুত্ব অনস্ব^ীকার্য। জনপরিবহনসহ বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, পণ্যপরিবহন ইত্যাদির জন্য সড়ক, রেল ও নৌপথের সুবিধা নিশ্চিত ও বিস্তৃত করার বিকল্প নেই। এই ত্রিমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সুষম উন্নয়ন যেমন অপরিহার্য তেমনি এদের পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় থাকাও অপরিহার্য। উন্নত দেশগুলোতে এই তিন যোগাযোগ ব্যবস্থাকেই বাস্তবানুগ গুরুত্ব দেয়া হয়। সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। এর কাক্সিক্ষত সুফল তারা পাচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশও সড়ক, রেল ও নৌপথের উন্নয়ন ও এদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে অধিকতর সুফল চয়নের চেষ্টা করছে। আমাদের দেশে এই তিনটি যোগাযোগ ব্যবস্থাই বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু এদের উন্নয়ন ও প্রসারণ সমান গুরুত্ব পাচ্ছে না এবং এদের মধ্যে সমন্বয়েরও অভাব রয়েছে। লক্ষ্য করলে এটা সহজেই প্রতীয়মান হবে, এখানে সড়ক পথকে তুলনামূলকভাবে বেশী গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সড়কপথের পরিধি বাড়ছে। প্রতিবছর নতুন নতুন সড়ক নির্মিত হচ্ছে। সড়কের উন্নয়ন হচ্ছে। এ জন্য বিপুল অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। সড়কের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া কিংবা নির্ভর করার কারণে ফসলি জমি যেমন কমছে, তেমনি যান্ত্রিক যানবাহনের আমদানি ও সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে জ্বালানি আমদানি ব্যয়। একই সঙ্গে বাড়ছে যানজট ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা। পক্ষান্তরে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত রেলপথের সম্প্রসারণ তো হয়ই নি বরং সংকুচিত হয়েছে। এর উন্নয়ন ও সেবা-সুবিধা বাড়ানোর তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সবচেয়ে বেশী অবহেলার শিকার হয়েছে নৌপথ। এক সময় নৌপথই ছিল জনপরিবহন ও পণ্যপরিবহনের প্রধান মাধ্যম। আর এখন নৌপথে সবচেয়ে কম জন ও মালামাল পরিবাহিত হয়ে থাকে। নৌপথকে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। ভারতের পানি রাজনীতির কারণে নদ-নদী নাব্যতা হারিয়েছে। নৌপথ সংকুচিত হতে হতে শুকনার সময় কয়েক হাজার কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্ষা মওসুমে অবশ্য ১৮ হাজার কিলোমিটারের মধ্যে নৌপথ পুনরুজ্জীবিত হয়। সারাবছর নৌপথ নাব্য রাখার জন্য নিয়মিত ড্রেজিং অপরিহার্য হলেও এটি উপেক্ষিত হচ্ছে। পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। কার্যত, ত্রিমুখী নয়, এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা একমুখী বা সড়কমুখী হয়ে পড়েছে।
ত্রিমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সুষম উন্নয়ন না হওয়ায় এবং এদের মধ্যে সুসমন্বয়ের অভাব থাকায় পণ্য পরিবহনে কি ধরনের দুর্ঘট দেখা দিয়েছে তার একটি চিত্র ইনকিলাবের এক রিপোর্টে উঠে এসেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক পণ্যপরিবহন এখন পুরোপুরি একমুখী বা সড়কপথনির্ভর হয়ে পড়েছে। বিকল্প রেল ও নৌপথে আমদানি-রফতানির পণ্য খুব কমই পরিবাহিত হচ্ছে। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও আন্তঃজেলা সড়কে যানজট প্রকট আকার ধারণ করছে। এছাড়া জনদুর্ভোগ বৃদ্ধিসহ পণ্যসামগ্রী চুরি, লোপাট, জ্বালানি ও পরিবহন খরচ বেড়ে চলেছে। পণ্য পরিবহনে রেল ও নৌপথকে ব্যবহার করায় কার্যকর উদ্যোগ নেই। একথা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, দেশের আমদানি-রফতানির প্রায় ৮০ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে হয়। এই বন্দর দিয়ে বছরে ২০ লাখ ১৫ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার এবং সাড়ে ৫ কোটি টন পণ্যসামগ্রী আমদানি-রফতানি করা হয়। আমদানিকৃত পণ্যসামগ্রীর অধিকাংশই আসে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার ও নারায়ণগঞ্জে। রফতানি পণ্যেরও বেশীর ভাগ এসব এলাকা থেকে যায়। এত বিপুল পণ্যসামগ্রীর সামান্য বাদে সবই সড়কপথে পরিবহন করা হয়। এতে সড়কের ওপর কি ধরনের চাপ পড়ে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রতিদিনের চিত্র থেকেই তা অনুধাবন করা যায়। অথচ এ পণ্যসামগ্রী পরিবহনে যদি সড়কের সাথে রেল ও নৌপথেরও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হতো তাহলে সড়কে এতো চাপ সৃষ্টি হতো না। এ তিন পথের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে পণ্য পরিবহন করা হলে সব দিক দিয়েই সুবিধা হতো। রেল সহজ, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা। নৌপথ তার চেয়েও সহজ ও সাশ্রয়ী। এ দু’টি পথ উপেক্ষিত। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের পানগাঁও কন্টেইনার টার্মিনাল চালু হলেও ব্যবহারকারীদের অনীহার কারণে নিয়মিত চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাস্তবিক কারণেই নৌপথের ওপর অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। নৌপথ পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে সাশ্রয়ী, এ বিবেচনাতেই তারা নৌপথের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। আর আমাদের দেশে নৌপথ ও পণ্যপরিবহন ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে এবং যতটুকু সুবিধা আছে তাও ব্যবহৃত হচ্ছে না। ব্যবহারকারীরা আগ্রহী হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
ঢাকা-চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। এটাও সড়ক নির্ভরতারই সাক্ষ্য বহন করে। আমরা মনে করি, সড়ক পথকে যথা প্রয়োজন গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। কিন্তু যেখানে উপযুক্ত বিকল্প রয়েছে সেখানে সেই বিকল্পকেও গুরুত্ব দেয়া উচিত। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে রেল যোগাযোগ রয়েছে। নৌপথেও সেখানে পণ্য পৌঁছানো ও নিয়ে আসা যায়। এমতাবস্থায় রেল ও নৌপথকেই প্রাধান্যে আনতে হবে। পণ্যপরিবহনে রেলকে কিভাবে আরও ব্যবহার করা যায় সেটা ভাবতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধুমাত্র পণ্যপরিবহনের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম আলাদা রেল লাইন হতে পারে। অনুরূপভাবে নৌপথের ব্যবহার বাড়াতে হবে। নৌপথের কোথাও নাব্যতার সংকট থাকলে নিয়মিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে তা কার্যকর রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। মোটকথা, ত্রিমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পূর্ণ সক্ষমতায় কাজে লাগাতে হবে। তাহলে জন ও পণ্যপরিবহনেও যে সংকট, অব্যবস্থা ও দুর্ভোগ চলছে তার অবসান হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন