শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আগে ক্ষতিপূরণ পরে প্রকল্প

প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভূমি জটিলতা নিয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার প্রত্যন্ত উপকূলীয় গ-ামারা ইউনিয়নে গত সোমবার ১৪৪ ধারা ভেঙে বিক্ষোভরত গ্রামবাসীর সাথে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৪ গ্রামবাসী নিহত হয়েছেন। ১০ পুলিশ, আনসার সদস্যসহ আহত হয়েছে ৩০ জন। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত আহতদের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে গ-ামারা গ্রামের মরহুম আশরাফ আলীর ছেলে মরতুজা আলী (৫২), তার ভাই আংকুর আলী (৪৫), একই এলাকার নূর আহমদের ছেলে জাকের আহমদ (৩৫) মারা গেছেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) ৪ জন নিহত হবার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, নিহত জাকের আহমদের লাশ চমেক হাসপাতালে আনা হয়েছে। বাকি দু’জনের লাশ গ্রাম থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করছে পুলিশ। বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামসুজ্জামানও সংঘর্ষে ৪ জনের নিহত হবার কথা স্বীকার করেছেন। ঘটনার কারণ সম্পর্কে পুলিশ ও স্থানীয় এলাকাবাসীর উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়েছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের জমি কেনা, দালালী ও দখলবাজি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশ কিছুদিন ধরে বিরোধ ও উত্তেজনা চলছিল। গত সোমবার দুপুরে দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি সমাবেশকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। স্থানীয়রা ১৪৪ ধারা ভেঙে সমাবেশ ও মিছিল করলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। সংঘর্ষ বেধে গেলে পুলিশ গুলি ছোড়ে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, নির্বিচারে গুলি করেছে পুলিশ। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান অরিফুল্লাহ জানিয়েছেন, দুই দিন অগে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করতে গিয়ে গ্রামবাসীর হামলার কবলে পড়েছিলেন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের কয়েকজন কর্মকর্তা। ওই ঘটনায় বাঁশখালী থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। দায়েরকৃত মামলার ৭ আসামীকে ঘটনার দিন সকালে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এর প্রতিবাদে সাবেক চেয়ারম্যান লেয়াকত আলীর নেতৃত্বে হাজীপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বসতবাড়ী রক্ষা কমিটির ব্যানারে সমাবেশ আহ্বান করা হয়েছিল। একই স্থানে পাল্টা সমাবেশ আহ্বান করেছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা।
প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র্র সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও এস আলম গ্রুপকে আলোচ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দেয়া হয়েছে। ঘটনার মূল কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে শুরু থেকেই এলাকাবাসীর সাথে কর্তৃপক্ষের মতবিরোধ ছিল। বসতভিটা থেকে শুরু করে মসজিদ-মন্দিরের জায়গাও প্রকল্পে ঢোকানো হয়েছিল। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, বাঁশখালী গ-ামারা-বড়ঘোনায় ৭ হাজারেরও বেশি বসতবাড়ি, ৭০টি মসজিদ-মক্তব, কবরস্থান, একটি কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্র,একটি উচ্চ বিদ্যালয়, ৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দু’টি আলিয়া মাদ্রাসা, ৫টি বাজার, একটি মিনি সমুদ্রবন্দর, ২০টি ছোটবড় আশ্রয়কেন্দ্র ও একটি সরকারি হাসপাতাল থাকলেও মাত্র ১৫০টি বসতবাড়ি দেখিয়ে বড়ঘোনা-গন্ডামারা মৌজার বিপুল পরিমাণ জমি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য খরিদ করার অনুমতি দিতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের যোগসাজশে উপজেলা ভূমি অফিস জেলা প্রশাসকের কাছে প্রস্তাব পাঠায়। প্রতিবেদনে মাত্র ১৫০টি বসতবাড়ি পুনবার্সনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়াও জমির দালাল ও মধ্যস্বত্ব ভোগী শ্রেণী কয়লা বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে প্রকৃত তথ্য না দিয়ে একের জমি অন্যজনের কাছ থেকে কিনে নেয়া, সঠিক মূল্য না দেয়া, প্রকৃত ক্রেতা তথা এস আলম গ্রুপের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করতে না দেয়াসহ অনেক কিছুই আড়াল করা হয়েছিল। প্রায় দু’বছর ধরে সাধারণ এলাকাবাসী তথা ভূমির প্রকৃত মালিকরা প্রতারণার নানা বিষয় নিয়ে ফুঁসছিল। এসব নিয়ে এলাকাবাসীর সাথে প্রকল্পে কর্মরত লোকজনদের সংঘর্ষ, হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনাও ঘটেছে। শনিবার এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের বড়ভাই এলাকা পরিদর্শনে গেলেও এলাকাবাসী তাদের গাড়ী বহরে হামলা করেছিল। এলাকাবাসীর অভিযোগ রয়েছে, প্রতারিত স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কয়লাবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের নানা বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলেও এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও একজন সংসদ সদস্য জড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি এত বড় আকার ধারণ করে।
বাঁশখালীর মর্মন্তুদ ঘটনা প্রমাণ করে অস্তিত্বের চেয়ে উন্নয়ন বড় নয়। একটু পিছন ফিরে তাকালে ভারতের পশ্চিমবাংলার সিঙ্গুরের ঘটনাও স্মৃতিতে ভেসে ওঠার কথা। সেখানেও টাটা কোম্পানীর ন্যানো গাড়ির কারখানা করার জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল মুসলিম প্রধান সিঙ্গুর অঞ্চলকে। সাধারণ মানুষের চাষের জমি, বসতভিটা নিশ্চিহ্ন করে যে উন্নয়নের বুলি সেখানে কপচানো হয়েছিল সিঙ্গুরবাসী তা গ্রহণ তো করেইনি বরং এ ঘটনা সেখানে বামফ্রন্ট সরকারের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাঁশখালীর ঘটনার বিশ্লেষণ প্রমাণ করছে ব্যাপারটি একদিনে বা হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা নয়। কেন এবং কি কারণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ঘটনার মীমাংসা না করে জিইয়ে রেখেছেন, সেটি যেমনি পরিষ্কার নয় তেমনি স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরাও কেন এত কিছুর পরেও পরিস্থিতির সুষ্ঠু ও ন্যায়সংগত সমাধানের দিকে যান নি সেটিও অস্পষ্ট। পূর্ব থেকে সতর্ক হলে অবশ্যই এতগুলো প্রাণ ঝরে পড়ত না বা পড়ার মত বাস্তবতা তৈরি হতো না। যেসব প্রাণ অবেলায় ঝরে গেছে তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। এটা মনে রাখতে হবে অনেক বড় বড় উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। সে বিবেচনায় এই অবাঞ্ছিত ঘটনার প্রতিবিধানে সর্বাগ্রে সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমি এবং সংশ্লিষ্টদের অব্যবস্থাপনার কারণে এমন ঘটনা ঘটে থাকলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্তৃপক্ষকে নিহত ও আহতদের পরিবারকে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আমরা মনে করি, ক্ষতিপূরণ ও ঘটনার তদন্ত শেষ না করে কোন বিবেচনাতেই প্রকল্পের কাজে হাত দেয়া সংগত হবে না। সংশ্লিষ্ট সকলে আন্তরিক হবেনÑ এটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করে।

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন