রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

মন শরীর ও রোগ

প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মেয়েটির নাম মাধবী (ছদ্মনাম)। বয়স ২০ বছর। গ্রামের বাড়ি নাটোর জেলায়। বাবা আদর্শবান স্কুল শিক্ষক ও মা গৃহিণী। তারা দুই বোন। মাধবী জন্মের পর তার মা নাকি খুশি হতে পারেননি। কোন ছেলে নেই বলে তিনি বলেছিলেন, “তুই ছেলে হলেই ভালো হতো!” ছেলে তাদের আকাক্সক্ষা ছিলো কিন্তু মেয়ে নয়! এ কথাটি শোনার পর মাধবী মনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলো। এখনো যখন মনে হয় খুব কষ্ট জেগে উঠে মনের ভেতর। ছোটবেলা থেকেই বাবার ইচ্ছে মেয়ে খুব ভালো ফলাফল করবে। সে আশা নিয়েই মেয়ে কে পড়াশোনা করিয়েছেন। বাবা আশা করেছিলেন অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষায় তার মেয়ে খুব ভালো রেজাল্ট করবে। কিন্তু ফলাফল খারাপ করায় বাবা মনের কষ্টে মাধবী কে খুব মেরেছিলেন! খুব কষ্ট পেয়েছিলেন বাবা। কষ্ট পেয়েছিলো মাধবী নিজেও। মাধবী ঘরের দরজা বন্ধ করে ছুরি দিয়ে নিজেই নিজের হাত কেটে রক্তাক্ত করেছিলো সেই দিন। এসএসসি পরীক্ষার সময় বাবা চেয়েছিলেন মাধবী যেন এবার অন্তত, এ প্লাস পায়। কিন্তু ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায় তার মেয়ে শুধুমাত্র এ গ্রেড পেয়ে পাস করেছে। বাবা আবারো আগের মতন কিংবা আগের চেয়েও বেশি কষ্ট পায়। বাবার কষ্ট দেখে মাধবীরও খুব কষ্ট হয়। সে চেয়েছিলো নিজের সবটুকু চেষ্টা দিয়ে নিজের পরিবারকে ভালো রাখতে কিন্তু সেই চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে মাধবী। খুব কষ্ট পায়। যখন-ই এসব মনে পড়ে, মন খারাপ হয়ে যায় তার। ছোটবেলা থেকেই মাধবীর প্রচ- জেদ। নিজে নিজে সে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না, অন্যদের সাহায্য লাগে। কিন্তু যদি সে একবার মনে মনে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলে, তখন অন্যরা যে যাই বলুক সেই সিদ্ধান্ত আর পরিবর্তন করতে পারে না। জোরে জোরে চিৎকার চেঁচামেচি করে। হাতের কাছে কিছু থাকলে তা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কেউ বকাবকি করলে বা কোন বিষয়ে জোরাজুরি করলে তখন খুব খারাপ লাগে। নিজের কাজগুলো ও অন্যদের দিয়ে করাতে হয়। আগে সে খুব একটা বেশি কথা বলতো না। কিন্তু এখন অতিরিক্ত কথা বলে ফেলে। মাধবী প্রায়ই বাঁচতে ইচ্ছে করে না। মরে যেতে ইচ্ছে করে। মেয়ে হয়ে জন্মানোই বুঝি তার আজন্ম পাপ! তবে আত্মহত্যা করার কোন ইচ্ছে নেই তার। কারণ আত্মহত্যা করা মহাপাপ। সে যেভাবে চায় যদি না পায় তখন তার মনে হয় সবাই তাকে অবহেলা করছে। কেউ তাকে বুঝতে চায় না। তখন সে সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু পরে আবার খুব অনুশোচনা বোধ হয়। তার প্রচুর মাথাব্যথা করে এখন। মাথা জ্বালা করে। পায়ের নখ থেকে শুরু করে সারা শরীরের প্রত্যেকটি অংশ ব্যথা করে। খুব দুর্বল লাগে। তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে যায় সে। সারাদিন বাসায় মন মরা হয়ে থাকে। আবার বাইরে গেলেও কারো সাথে হাসিখুশি থাকতে পারে না। লোক সমাগম, কোলাহল কিছুই ভালো লাগে না। একা একা বিষণœতায় কেটে যায় তার সারাদিন রাত। জীবনে কি করলাম, কি করবো, কি হবে তা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা হয়। ভাবনা হয়, দুই বোনের-ই বিয়ে হয়ে গেলে বাবা মার সংসারের কি হবে? তবে মাধবী এমন একজন কেই জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়, যে তাকে বুঝবে। মূল্যায়ন করবে। কোন কষ্ট পেতে দেবে না। মাধবীর মাসিকেও সমস্যা হচ্ছে। একবার শুরু হলে আর বন্ধ হতে চায় না। প্রত্যেক মাসে হয় কিন্তু অনেক দিন ধরে থাকে। যখন সে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ত তখন একবার প্রায় একমাস ধরে মাসিক ছিলো। এলোপ্যাথিক চিকিৎসা নিয়ে বন্ধ হয়েছিলো। কিন্তু আবার শুরু হয়ে একটানা তিন মাস হয়েছিলো। এলোপ্যাথিক মেডিসিন খেয়েও আর কন্ট্রোল হয়নি। মাসিক হওয়ার আগে ব্যথা হয় তার সাথে সাথে মাথাও ঘোরায়। পেটে গ্যাস হয় এবং পায়খানাও অনিয়মিত এবং শক্ত হয়। সে খাওয়া-দাওয়া কম করা সত্ত্বেও দিন দিন মোটাই হয়ে যাচ্ছে। কয়েক মাস চিকিৎসার পর মানসিক অবস্থা এখন আগের চেয়ে খুব ভালো। এখন আর আগের মতন মনে হয় না। মাসিক বন্ধ হয়েছে। তবে মাথা ঘোরা এখনো আছে।
বিশ্লেষণ
শৈশবে, কৈশোর কিংবা যৌবনের অবরুদ্ধ মানসিক কষ্টগুলো আমাদের পরবর্তী জীবনে প্রভাব ফেলে। মনের উপর বিরূপ ক্রিয়া আমাদের দেহের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। মানসিক কষ্টগুলো শারীরিক স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে বিভিন্ন রোগ শারীরিক রোগ সৃষ্টি হয়ে শুরু হয় মানসিক অশান্তি। জীবনের সুখ শান্তি বিঘিœত হয়। ছন্দপতন ঘটে দৈনন্দিন জীবনে। পরামর্শ : একটি সুন্দর সুস্থ মন-ই সুন্দর জীবনের পরিপূরক। শিশুকে মারবেন না। অযথা বকাঝকা করবে না। এগুলো শিশুর মনের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে তাকে স্বাভাবিকভাবে বড় হতে বাঁধা দেয়। পারিবারিক কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে ‘সম্পর্ক’ আরো গাঢ় করতে হবে। এতে ভুল বোঝাবোঝি ও পরিবারের সদস্যদের মাঝে দূরত্ব কমবে। এবং বাড়বে পারস্পরিক সহমর্মিতা। ছেলে-মেয়ে সন্তানের মধ্যে বৈষম্য না করে সমান দৃষ্টিতে দেখুন। ছেলে আপনার হলে, মেয়েও তো আপনারই। শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশে মা বাবা ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের কোন বিকল্প নেই। ‘তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না!’- এ জাতীয় কথা বলে তার যোগ্যতা কে ছোট করবেন না। এইসব অপমানজনক কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। ছেলে-মেয়ের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিতে শিখুন। প্রতিদিন শত ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানকে সময় দিন। তাদের কথাগুলো সময় করে শুনুন। বিশ্বাস রাখুন তাদের উপর। কন্যাসন্তানের উচ্চ শিক্ষা ও সুন্দর কর্মজীবন পেতে সহয়তা করুন। মনে রাখবেন, একটি সামান্য রেজাল্ট কার্ড নয়, বরং বাস্তব জীবনে কর্ম-ই একদিন আপনার সন্তানকে সফলতা এনে দিবে। তাই আপনার সন্তানকে শুধু পরীক্ষাতে এ প্লাস পেতে নয়, জীবন যুদ্ধে প্রথম হওয়ার গুণাবলী অর্জনে উদ্বুদ্ধ করুন। সন্তানদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা বাবা মায়ের অন্যায়কে ক্ষমার চোখে দেখুন। তাদের উপর মান-অভিমান না করে, বিরক্ত না হয়ে হাসিমুখে বুঝিয়ে কথা বলুন। তাদের পরামর্শগুলো বিচক্ষণতার সাথে গ্রহণ করুন। মনে রাখবেন- পরিবারের মানুষগুলোই আপনার সবচেয়ে আপন জন। যেকোন সমস্যাতেই ভেঙে পরবেন না। সাহস রাখুন নিজের উপর। আর হয়ে উঠুন একজন আদর্শবান অনন্য মানুষ।
ষ ডা. আনোয়ার এইচ বিশ্বাস
এমএসএস- ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্ক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) বিএইচএমএস
প্রভাষক (অনা) সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
০১৭১১৩৪৫৩৮৭ ই-মেইল : ফৎধহধিৎযন@ুধযড়ড়.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন