জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ গত সোমবার গুলশান এলাকা থেকে একটি বিএম ডব্লিউ এক্স-৫ জীপ আটক করে। অভিযোগ করা হয় যে, এই গাড়ীটি আমদানি করার সময় আমদানিকারক কর ফাঁকি দিয়েছেন। কর এবং শুল্কসহ গাড়ীটির মূল্য ৫ কোটি টাকা। প্রাথমিক তদন্তের পর শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ দেখতে পেয়েছে, এই গাড়ীটি আমদানি করা হয়েছে কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধার অধীনে। এই কার্নেটে যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে সেগুলো লঙ্ঘন করে গাড়ীটি রাস্তায় চলাচল করছে। এই কার্নেট সুবিধা অনুযায়ী বাংলাদেশে বিদেশী পর্যটকরা তাদের ব্যবহৃত গাড়ী বাংলাদেশে আমদানি করতে বা আনতে পারেন। এই জন্য তাদের কোনো শুল্ক বা কর দিতে হয় না। কার্নেট সুবিধা দেয়ার সময় এই শর্তও দেয়া হয় যে, যে দেশ থেকে এই গাড়ীটি আমদানি করা হয়েছে, আমদানি করার ১ বছরের মধ্যে ঐ গাড়ীটি সেদেশে ফেরত পাঠানো হবে।
গত বুধবার ৬ এপ্রিল ইংরেজী দৈনিক ‘দি নিউ এজে’ প্রকাশিত রির্পোট মোতাবেক, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, এই ধরনের ৩০০টি বিলাসবহুল গাড়ী আমদানি করা হয়েছিলো। এরমধ্যে এখনো বাংলাদেশে ১৪৭টি গাড়ী রয়ে গেছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেগুলো ফেরত পাঠানো হয়নি। ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে ঐসব আমদানিকারক বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির কাছ থেকে বেআইনী পন্থায় রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে। এইভাবে ভুয়া রেজিস্ট্রিশন নিয়ে ঐসব গাড়ী এখন রাস্তায় চলাচল করছে। আলোচ্য বিএম ডব্লিউ জীপটির মালিক হলেন কাজী রেজাউল মোস্তফা। তিনি গুলশান ১০৪ নম্বর সড়কের ৫জি বাসভবনে বসবাস করেন। কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক আরো জানান, এই ঘটনার সাথে মুদ্রাপাচার বা অন্য কোনোরকম ফৌজদারি অপরাধ জড়িত কিনা সেটিও দেখা হবে। কেমন করে গাড়ীটির রেজিস্ট্রেশন হলো অথবা তার ফিটনেস নবায়ন করা হলো সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি আরো জানান, ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এই সব বিলাসবহুল গাড়ী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসব গাড়ী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে কার্নেট প্যাসেজের অধীনে। যারা আমদানি করেছেন তাদের প্রায় সকলেই বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণকারী বিদেশী নাগরিক। এই ৩০০টি গাড়ীর মধ্যে ১৪৭টি গাড়ী ফেরত পাঠানো হয়নি। কার্নেট সুবিধা ভঙ্গ করার অভিযোগে ইতোমধ্যেই ৩টি বিলাসবহুল গাড়ী আটক করা হয়েছে। কাস্টমস বিভাগ এই ধরনের আরো ৪টি গাড়ী শনাক্ত করেছে যেগুলো চুক্তি ভঙ্গ করে আমদানি করা হয়েছে। বাংলাদেশ এবং দুবাইয়ের মধ্যে এয়ার সার্ভিসেস এভিয়েশন চুক্তির অধীনে দুবাই এভিয়েশন কর্পোরেশন শুল্ক মুক্ত ব্যবস্থার অধীনে এসব গাড়ী আমদানি করেছে। অথচ চুক্তিতে শুল্ক মুক্ত গাড়ী আমদানির কোনো ব্যবস্থা নাই। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আমদানিকারকরা যদি গাড়ীগুলো ফেরত দেন তাহলে যে সমস্ত কর এবং শুল্ক প্রযোজ্য শুধুমাত্র সেগুলোই আদায় করা হবে। এর বাইরে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।
অপর একটি খবরে প্রকাশ, রাজধানীর গুলশান থেকে কর ফাঁকি দিয়ে ব্যবহার করা পোরশে ব্র্যান্ডের বিলাস বহুল একটি গাড়ী জব্দ করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগ। জব্দকৃত গাড়ীটির মালিক প্যাসিফিক গ্রুপের স্বত্ত্বাধিকারী শফিউল আজম। তবে গাড়ীটি ব্যবহার করতেন তার স্ত্রী শোবিজ তারকা জাকিয়া মুন। তিনি ২০১২ সালে ‘কেয়া শেঠ মিস অদ্বিতীয়া বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক ড. মঈনুল খান বলেন, গোয়েন্দা সূত্রের ভিত্তিতে গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় গাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে কর আদায়ের প্রক্রিয়া চলছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত বুধবারের আটক করা গাড়িটিও একই কায়দায় দেশে আনা হয়। পরে ব্যবসায়ী শফিউল আজম তা কিনে নেন। এখনো যে ১৪৭টি গাড়ী বাংলাদেশে অবৈধভাবে চলাচল করছে সেই গাড়ীগুলোর আনুমানিক মূল্য ৬০০ কোটি টাকা। এসব গাড়ী থেকে সরকার অন্তত পক্ষে ৩০০ শত কোটি টাকার ট্যাক্স পেতো। সেই ট্যাক্স থেকে সরকার বঞ্চিত হয়েছে। এখন দেখতে হবে যে এসব গাড়ী কারা এনেছে। পত্র-পত্রিকায় বলা হয়েছে যে, এসব গাড়ী আটক করার জন্য সরকার নাকি অভিযান শুরু করেছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, এই ধরনের অভিযান কোনোদিন সফল হয়নি। আর তাছাড়া ডাকঢোল পিটিয়ে এই ধরনের অভিযানের প্রয়োজনই বা কি আছে! কারা বেআইনীভাবে এসব গাড়ী আমদানি করেছে, কারা ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছে তার সমস্ত তথ্য সরকারের নিকট আছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দেখতে হবে যে, এই ধরনের গাড়ী আমদানির ক্ষেত্রে আইন মোতাবেক পালনীয় সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ করা হয়েছে কি-না। যারা আইন মেনে চলেনি এবং চোরাপথে আমদানি ও পরে বিক্রি করেছে তাদের নামধাম, ঠিকানা সব কিছুই সরকারের কাছে আছে। ঐসব কাগজপত্র বের করে একটি একটি করে কেস পরীক্ষা করে আইন ভঙ্গকারীদেরকে পাকড়াও করতে হবে, তাদের গাড়ী জব্দ করতে হবে এবং পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো, সেটি জনগণকে জানাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে সংঘটিত টাকা চুরি এবং পানামা বিস্ফোরণের মাধ্যমে উন্মোচিত টাকা পাচারের ঘটনা মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে। পানামা বিস্ফোরণে প্রকাশিত বিদেশে টাকা পাচারকারী যে ২৩ জন বাংলাদেশীর নাম এসেছে তাদের বিষয়টিও গভীরভাবে সরকারকে অনুসন্ধান করতে হবে। এর আগে বিভিন্ন ব্যাংক কেলেঙ্কারীর মাধ্যমে ২৮ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠিত হয়েছে। কোনটিরই বিচার হয়নি। এখন আবার বিলাসবহুল গাড়ী আমদানির ক্ষেত্রেও কর ফাঁকি দিয়ে কয়েক শত কোটি টাকা লুণ্ঠন করা হচ্ছে। এদের কাউকেও ছাড়া উচিত হবে না। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি দুর্নীতি এবং লুণ্ঠনকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইন মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন