শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নদী ও বনভূমি দখল রুখতে হবে

প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নদ-নদীর সুপেয় পানি, কৃষিজমি এবং বনভূমি দেশের মানুষের মূল সম্পদ। এসব প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারকে বিপণœ করে দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। যেনতেন প্রকারে সাময়িক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে যে উন্নয়নের সূচক তুলে ধরা হয়, তা এখন ভ্রান্ত ও অচল পন্থা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সামাজিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ভুল ও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও উন্নয়ন ভাবনার বিরূপ প্রভাব ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মধ্য দিয়ে একশ্রেণীর মানুষ নদী দখল, বনভূমি দখল ও শিল্পদূষণের মাধ্যমে রাজধানী শহর থেকে শুরু করে সারাদেশকেই এখন একটি বিরাণ, ঊষর, বসবাস ও চাষাবাদের অযোগ্য ভূমিতে পরিণত করতে শুরু করেছে। এমনিতেই উজানে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার এবং বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নদনদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে বিশীর্ণ নালায় পরিণত হচ্ছে অন্যদিকে নদী এবং নদী শিকস্তি ভূমি সংরক্ষণসহ নদীবক্ষের পলি অপসারণের মাধ্যমে নদীর প্রবাহ ঠিক রাখার কার্যকর সরকারী উদ্যোগ না থাকায় নদীগুলো এখন কৃষি ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। পদ্মা-মেঘনা, গড়াই, ধলাই, গোমতির বুকে জেগে ওঠা চরাঞ্চলে সাদা কাশবন অথবা সবুজ ফসলের সাথে আমরা পরিচিত। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, এক সময়ের কাকচক্ষু জলের কপোতাক্ষ নদের শুকনো বুকে এখন ইট-পাথরের ইমারত গড়ে তুলছে একশ্রেণীর প্রভাবশালী দখলবাজ। কপোতাক্ষ নদের বুকে অবৈধ দখলবাজরা অট্টালিকা নির্মাণ করলেও স্থানীয় প্রশাসন নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ঘাঘট ও মানস নদীর পানিশূন্য বুকে চাষীরা চাষাবাদ করছে বলে গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত আরেকটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়। প্রথমে চাষাবাদ, অত:পর ভরাট, পাকা স্থাপনা নির্মাণ, এভাবেই নদীগুলোর মৃত্যু নিশ্চিত করা হচ্ছে।  
গতকালের ইনকিলাবে প্রকাশিত আরো কয়েকটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘দখলদারদের কব্জায় মধুপুর শালবনের ৩৬ হাজার একর জমি উদ্ধারে নেই কোন পদক্ষেপ’। ‘জনবল সঙ্কটে ১ লাখ ৭৭ হাজার একর বনজসম্পদ অরক্ষিত’ ইত্যাদি। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীব-বৈচিত্র্য, খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়নের মূল ভিত্তিগুলোকেই দূষণ ও দখলবাজির কবলে পড়ে ধসে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে রাজধানী শহর ঢাকা নগরী বিশ্বের অন্যতম নোংরা ও অনিরাপদ শহরের তালিকার প্রথম সারিতে স্থান পেয়েছে। ঢাকার চারপাশের নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালুনদীর ভয়াবহ দূষণ, বেপরোয়া দখলবাজি ঢাকা শহরের নাগরিক দুর্ভোগ ও নানাবিধ সংকটের অন্যতম মূল কারণ। একদিনে বা দু’এবছরে এ সঙ্কট এমন প্রকট আকার ধারণ করেনি। গত চারদশকে অনেক সরকার বদল হলেও নদী ও বনভূমি দখল ও দূষণের চিত্র বদলায়নি। মূলত: রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের নেপথ্য ছত্রছায়ায় এসব দখল-দূষণবাজির অপরিণামদর্শী খেলা চলছে।
একদিকে পদ্মা, মেঘনা, কপোতাক্ষ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যাসহ দেশের সব নদীই এখন দখলবাজি ও শিল্পদূষণের শিকার হয়ে ভরাট ও দুর্ঘন্ধযুক্ত নালায় পরিণত হচ্ছে অন্যদিকে সুন্দরবন থেকে শুরু করে মধুপুর শালবন, ভাওয়ালের বনাঞ্চল, লাউয়াছড়া কক্সবাজার ও মহেশখালির রির্জাভ ফরেস্ট এবং উপকূলীয় সবুজবেস্টনীসহ প্রতিটি রেঞ্জের বনভূমির লাখ লাখ একর জমি অবৈধ দখলবাজদের কব্জায় চলে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল বনজসম্পদ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সারাদেশে বনবিভাগের ২ লাখ ৫৭ হাজার একর জমি প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে রয়েছে। এসব জমিতে ব্যক্তিগত খামার ও বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্টদের সহায়তা এবং অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের দখলবাজি অব্যাহত রাখা অসম্ভব। বনবিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী একদিকে সরকারী বনভূমি সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা জমিও নিরাপত্তাসহ সংরক্ষণ করতে পারছে না। বেদখল হওয়া আড়াই লক্ষাধিক একর বনভূমির মধ্যে গত কয়েক বছরে মাত্র ১২ হাজার একর জমি পুনরুদ্ধারের কথা জানা যায়। একটি ঘনজনবসিতপূর্ণ দেশের জন্য যে পরিমাণ বনভূমি থাকা প্রয়োজন বাংলাদেশে তার অর্ধেকও নেই। একইভাবে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রসহ হিমালয় থেকে আগত নদ-নদী পরিবাহিত পলিমাটি দ্বারা সৃষ্ট বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ হওয়ায় বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে নদনদীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। দেশের নদী এবং বনভূমি বেদখল ও দূষণের মধ্য দিয়ে মূলত বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অস্তিত্বকেই ভয়াবহ সংকটের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আমাদের সরকার ভারতের কাছ থেকে নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় যেমন ব্যর্থ হচ্ছে, একইভাবে পরিকল্পিত ড্রেজিং-এর মাধ্যমে নদীকে নাব্য রাখা অথবা সংরক্ষিত বনভূমিও রক্ষা করতে পারছে না। নদ-নদী ও বনভূমির মত অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রক্ষায় কোন সরকারের ব্যর্থতার সুযোগ নেই। নগরায়ন, শিল্পায়ণ, বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ, আবাসন বা উন্নয়নের নামে নদী ও বনভূমি দখলের মহোৎসব বন্ধ করতে হবে। এসব দখলবাজির সাথে যারাই জড়িত থাক, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে এবং বেদখল হওয়া জমি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন